রাতের অন্ধকারে টিশার মোটর বাইকের টায়ারের চিহ্ন খুঁজে বের করা খুব কঠিন, দিনের আলোতে সেটা অনেক সহজ। কিন্তু যতই দেরি হবে টিশা নিশ্চয়ই আরো বেশি দূরে চলে যাবে–কাজেই আমার হাতে নষ্ট করার মতো সময় একেবারেই নেই। আমি তাই দেরি না করে তখন তখনই কাজে লেগে গেলাম।
মোটর বাইকের হেডলাইট জ্বালাতেই সামনে অনেকখানি জায়গা আলোকিত হয়ে গেল। আমি তখন হাঁটুতে ভর দিয়ে বালুর উপর টায়ারের চিহ্ন খুঁজতে থাকি। কাজটি কঠিন কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দিলাম না, নিজের ভেতর কেমন যেন বিশ্বাস ছিল যে আগে হোক পরে হোক আমি টিশার মোটর বাইকের টায়ারের চিহ্ন খুঁজে পাবই।
কোথা থেকে শুরু করেছি সেটা মনে রাখার জন্য সেখানে অনেকগুলো ছোট-বড় পাথরের টুকরো জমা করে একটা বৃত্ত তৈরি করে রাখলাম। যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে একটা তিরচিহ্ন দিয়ে আমি তার সাথে লম্বভাবে টিশার মোটর বাইকের টায়ারের চিহ্ন খুঁজতে থাকি। খানিকটা দূরত্ব খোজা হলে আমি মোটর বাইকটা ঠেলে আরেকটু সামনে নিয়ে গিয়ে তার হেডলাইটের আলোতে আবার খুঁজতে থাকি।
এভাবে কত ঘণ্টা খুঁজেছি জানি না। একসময় আমার পিঠ এবং ঘাড় ব্যথা করতে থাকে। ঠিক কী কারণ জানা নেই আমার সে রকম খিদে পায়নি কিন্তু তারপরেও আমি একটু শুকনো খাবার এবং অল্প এক ঢোক পানি খেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বালুর উপর শুয়ে থাকলাম। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র, আমি অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমাদের ঘিঞ্জি শহরের কেউ কখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে কখনো কোনো নক্ষত্র দেখেছে বলে মনে হয় না।
এই প্রত্যেকটা নক্ষত্রের নাকি একটি করে নাম রয়েছে–আমি একটিরও নাম জানি না। কে জানে টিশা হয়তো এই নক্ষত্রগুলোর কোনো কোনোটির নাম জানে। আমি ঠিক মাথার উপরে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা একটা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিশ্চয়ই একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কেন জানি আমার ঘুম ভেঙে গেল, আমি উঠে বসলাম এবং দেখলাম আমার কাছাকাছি অন্ধকারে একা প্রাণী দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে প্রাণীটাকে চেনা যায় না কিন্তু তার। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। আমি ভয়ে আতঙ্কে উঠে বসতেই প্রাণীটা দুই পা পিছিয়ে গেল কিন্তু একেবারে সরে গেল না। স্থির দৃষ্টিতে সেটি আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি কাঁধ থেকে অস্ত্রটা নিয়ে জন্তুটার দিকে তাক করতেই সেটা হঠাৎ করে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
আমি আবার বালুতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। ঠিক মাথার উপর মিটমিট করে জ্বলতে থাকা উজ্জ্বল নীলাভ নক্ষত্রটি সেখানে নেই। কী আশ্চর্য, সেটি কোথায় চলে গেল? একটু মাথা ঘোরাতেই সেটাকে পেয়ে গেলাম। নক্ষত্রটি একটু বাম দিকে হেলে গেছে। কী আশ্চর্য, কেউ আমাকে কখনো বলেনি চাঁদ এবং সূর্যের মতো নক্ষত্রও আকাশে এক দিক থেকে অন্যদিকে হেলে পড়ে। আমি এই সহজ বিষয়টাও জানতাম না–টিশা নিশ্চয়ই জানে!
আমি আবার উঠে মরুভূমির বালুতে টিশার মোটর বাইকের। টায়ারের চিহ্ন খুঁজতে শুরু করি। যত কষ্টই হোক, যত কঠিনই হোক আমি সেটা খুঁজে বের করবই করব।
আমি কতক্ষণ এভাবে খুঁজেছি জানি না। যখন পূর্ব আকাশ একটু একটু আলো হতে শুরু করেছে তখন আমার প্রথম মনে হলো আমি। বালুতে খুব হালকা একটা টায়ারের দাগ দেখতে পেয়েছি। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাগটা পরীক্ষা করলাম, যদি সত্যি এটা টিশার মোটর বাইকের টায়ারের চিহ্ন হয়ে থাকে তাহলে সামনে এবং পেছনেও এটা খুঁজে পাওয়া যাবে।
আমি আমার মোটর বাইকটা টেনে কাছে নিয়ে এসে আলোটা সামনের দিকে ছড়িয়ে দিলাম, তারপর সেই আলোতে সামনে গিয়ে টায়ারের দাগটা খুঁজতে থাকি। আমার বুক তখন উত্তেজনায় ধক ধক করছে, মনে হচ্ছে যদি সামনে এর চিহ্ন খুঁজে না পাই? যদি দেখি এটা আসলে মোটর বাইকের টায়ারের চিহ্ন না, এটা আসলে অন্য কিছু?
আমি বিড় বিড় করে নিজেকে বললাম, “এটা যদি নাও হয় ক্ষতি নেই। আমি তবু খোঁজা বন্ধ করব না। আমি খুঁজতে থাকব, খুঁজতে থাকব আর খুঁজতে থাকব। যতক্ষণ টিশাকে খুঁজে না পাব আমি খোজা থামাব না।”
মোটর বাইকের হেডলাইটের আলোতে আমি সামনে এগিয়ে গেলাম, সত্যি সত্যি নরম বালুতে আমি আবার মোটর বাইকের টায়ারের দাগ পেয়ে গেলাম। আমার বুকে রক্ত ছলাত করে উঠল, উত্তেজনায় আমার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। আমি মোটর বাইক টেনে আরো সামনে নিয়ে গেলাম, আরো সামনে খুঁজে আবার মোটর বাইকের টায়ারের চিহ্ন পেলাম। টিশা যে হালকা ছোট একটা মোটর বাইক নিয়েছে এটা ঠিক সে রকম মোটর বাইকের টায়ারের চিহ্ন।
আমি তখন বালুতে বসে পড়লাম। হাঁটুতে ভর দিয়ে বালুর উপর সাবধানে এই চিহ্ন খুঁজে বের করা গেছে কিন্তু এই চিহ্ন ধরে মোটর বাইক চালিয়ে যেতে হলে আরো আলো দরকার। আমাকে সূর্য ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমি মোটর বাইকের হেডলাইট নিভিয়ে তার পাশে বালুতে শুয়ে পড়লাম। সারারাত ঘুমাইনি, কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলে খারাপ হয় না। উত্তেজনায় আমার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড ধক ধক করছে, আমি ভেবেছিলাম আমার চোখে ঘুম আসবে না। কিন্তু নরম বালুর উপর মাথা রাখতেই রাতের মরুভূমির শীতল বাতাস আমার সারা শরীর জুড়িয়ে দিল এবং কিছু বোঝার আগেই আমার দুই চোখে ঘুম নেমে এল।