আমি পা টিপে টিপে তার দিকে অগ্রসর হতে থাকি, ঠিক কী কারণ জানা নেই আমি নিজের ভেতর বিন্দুমাত্র ভয়ভীতি টের পেলাম না। নিজের ভেতরে বিচিত্র এক ধরনের আত্মবিশ্বাস। আমি নিশ্চিতভাবে জানি কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই আমি কাজটা শেষ করতে পারব।
সেন্ট্রিটার খুব কাছে পৌঁছানোর পর হঠাৎ কী কারণে সেন্ট্রি চোখ খুলে আমার দিকে তাকাল। আমি তখন আর দেরি না করে এক লাফ দিয়ে তার অস্ত্রটা হাতে তুলে নিয়ে তার দিকে তাক করে বললাম,
“দুই হাত উপরে তুলে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো!”
মানুষটা একটু দ্বিধা করছিল। আমি তখন চিৎকার করে বললাম, “খবরদার! দেরি করলেই গুলি!” শুধু যে কথাটা উচ্চারণ করেছি তা নয় মুহূর্তের জন্য মনে হলো দেরি করলে সত্যি বুঝি গুলি করে দিতে পারব।
মানুষটা তখন সত্যি সত্যি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল, দুই হাত মাথার উপর উঁচু করে রাখা। আমি কাছে গিয়ে তার বেল্টটা খুলে নিয়ে হাত দুটো পেছনে বেঁধে নিলাম। তারপর তার গলার স্কার্ফটা খুলে সেন্ট্রির মুখটা শক্ত করে বেঁধে দিলাম। নির্জন এই জায়গা থেকে তার ছুটে আসতে দশ পনেরো মিনিট লেগে যাবে, আমাকে তার মাঝে কাজ শেষ করে ফেলতে হবে। অস্ত্রটাকে দেখে অনেক ভারী মনে হয় কিন্তু সেটা আশ্চর্য রকম হালকা। আমি সেটা হাতে নিয়ে রাস্তা ধরে ছুটতে থাকি, প্রথম যে মোটর বাইক চোখে পড়বে সেটা ছিনিয়ে নিতে হবে।
প্রথম মোটর বাইকে একজন মা তার ছোট মেয়েকে পেছনে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাই তাকে ছেড়ে দিলাম। দ্বিতীয় মোটর বাইকে পাহাড়ের মতো বিশাল একজন মানুষ যাচ্ছে, তাকেও ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমার হাতে সময় নেই তাই ছোটখাটো একটা হুংকার দিয়ে তার সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মানুষটা অবাক হয়ে মোটর বাইক থামাল, আমি চিৎকার করে বললাম, “নেমে যাও! এই মুহূর্তে, না হলে গুলি করে দেব।”
আমার কথা শুনে মানুষটা এত অবাক হলো যে সেটি বলার মতো নয়, আমাদের এই শহরে এর আগে কখনোই কেউ কারো কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেনি। একজনকে অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখিয়ে যে কিছু একটা ছিনিয়ে নেয়া যায় এই শহরের মানুষেরা সেটা জানে না। মানুষটা আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল না, মোটর বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল।
আমি লাফিয়ে সেটার উপর উঠে মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেলাম। বড় কাজ দুটি শেষ, এখন কিছু শুকনো খাবার আর পানি জোগাড় করতে হবে। এই পথে একটা দোকান আছে কিন্তু সেখানে মানুষের ভিড় হবে বলে সেখানে না গিয়ে একটা ছোট অনাথ আশ্রমে হানা দিলাম। আমাকে দেখে সেখানে ছোট শিশুরা আতঙ্কে ছোটাচ্চুটি করতে থাকে, আমার কাজটি সে জন্যে সহজ হয়ে গেল। আমি অস্ত্র উঁচিয়ে চিৎকার করে বললাম, “দশ সেকেন্ডের মাঝে দশ গ্যালন পানি আর দশ কেজি শুকনো খাবার-এক সেকেন্ড দেরি হলে সবাইকে খুন করে ফেলব।”
দশ সেকেন্ডের মাঝে এগুলো দেওয়া সম্ভব না, আমার পক্ষেও কাউকে খুন করা সম্ভব না কিন্তু অনাথ আশ্রমের ম্যানেজার মেয়েটির এগুলো জানার কথা নয়–সে ছোটাচ্চুটি করে খাবার আর পানির প্যাকেট আনতে থাকে।
এক মিনিটের মাঝে আমি সেখান থেকে বের হয়ে প্রাচীরের দিকে ছুটতে থাকি। প্রাচীরের ঠিক কোন জায়গাটিতে গর্ত সেটি আমি বেশ ভালোভাবে জানি। জানি, সেটার উপর ভরসা করেই আমি সেদিকে ছুটে যেতে থাকি।
ঠিক তখন অনেক দূর থেকে সাইরেনের বিকট শব্দ শুনতে পেলাম। আমি আমাদের এই শহরে কখনো কোনো বড় ধরনের অপরাধ ঘটতে দেখিনি। কিছু একটা ঘটে গেলে কী করতে হয় মনে হয় কারো ভালো করে জানা নেই। তাই আমাকে ধাওয়া করার জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে প্রস্তুত করে আনতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গিয়েছে।
প্রাচীরের কাছে পৌঁছে আমি যখন গর্তটাকে খুঁজে বের করে তার ভেতরে ঢুকে মোটর বাইকটাকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি তখন বাইরে সশস্ত্র বাহিনীর গাড়িগুলো হাজির হয়েছে। তারা যখন আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন আমি প্রাচীরের অন্য পাশে বের হয়ে গেছি। মোটর বাইকের বাতি নিভিয়ে আমি নিঃশব্দে মরুভূমির লাল বালু উড়িয়ে ছুটে যেতে থাকি।
প্রাচীরের উপর সার্চলাইট জ্বালিয়ে নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনী যখন আমাকে খুঁজে বেড়াতে শুরু করেছে তখন আমি শহর থেকে বহুদূরে চলে এসেছি। আমাকে তারা আর কোনো দিন খুঁজে পাবে না।
কিন্তু আমার টিশাকে খুঁজে পেতে হবে। পেতেই হবে।
০৬. আমি টিশাকে খুঁজে বের করতে চাই
আমি টিশাকে খুঁজে বের করতে চাই। এই বিশাল মরুভূমিতে টিশা কোথায় আছে আমি জানি না। শুধু শুনেছি সে একবার বলেছিল উত্তরে একটা বনভূমি আছে, সেখানে একটা হ্রদ আছে, টিশা সেখানে যেতে চায়। তার কাছে নাকি একটা প্রাচীন ম্যাপও আছে–আমার কাছে কিছু নেই। সত্যি কথা বলতে কি আমি উত্তর-দক্ষিণও চিনি না। শুনেছিলাম আকাশে ধ্রুবতারা বলে একটা তারা আছে সেটা উত্তর দিকে থাকে, কিন্তু আমি সেটা চিনি না। টিশা হয়তো বই পড়ে সেটা শিখেছে, আমাকে কেউ শেখায়নি। কাজেই টিশাকে খুঁজতে কোন দিকে যাব আমি জানি না।
যখন মনে হলো আমি শহর থেকে মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছি তখন আমি আমার মোটর বাইকটা থামালাম। তারপর সেটাতে হেলান দিয়ে বসে ঠাণ্ডা মাথায় একটু চিন্তা করতে চেষ্টা করি। টিশা কোন দিকে গিয়েছে সেটা যেহেতু আমি জানি না, তাই খেয়ালখুশিমতো যে কোনো একদিকে রওনা দিয়ে লাভ নেই। আমি প্রাচীরের যে ফুটো দিয়ে বের হয়েছি, টিশাও সেই ফুটো দিয়ে বের হয়েছে, আমি যে রকম যত তাড়াতাড়ি শহর থেকে যতদূর সরে যাওয়া সম্ভব তার চেষ্টা করেছি, টিশাও নিশ্চয়ই তাই চেষ্টা করেছে। কাজেই মোটামুটি অনুমান করা যায় প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা আগে টিশা এই পথেই এসেছে। এরপর সে কোনদিকে গিয়েছে সেটা অনুমান করার কোনো উপায় নেই। টিশাকে খুঁজে বের করার আমি একটামাত্র উপায় চিন্তা করে বের করতে পারলাম, নরম বালুর উপর তার মোটর বাইকের টায়ারের চিহ্ন নিশ্চয়ই এখনো মুছে যায়নি। আমি যদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি তাহলে নিশ্চয়ই সেটা খুঁজে বের করতে পারব। সেটা যদি খুঁজে বের করতে পারি তাহলে সেটা ধরে এগিয়ে গেলে আগে হোক পরে হোক নিশ্চয়ই টিশাকে বের করে ফেলতে পারব।