আমি মাথা নাড়লাম, জানালাম যে আমি জানি না। টিশার মায়ের মুখে খুব বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠল। আমায় চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আর কিছু জানতে চাই না। তুমি যাও। আগে হোক পরে হোক ওরা তোমাকে খুঁজে বের করবে।”
আমি টিশাদের ফ্ল্যাট থেকে ছুটে বের হয়ে এলাম। বুকের উপর থেকে একটা পাষাণ নেমে গেছে। ওরা টিশাকে ধরতে পারেনি। আমার টিশা একটা মোটর বাইকে করে মরুভূমির লাল বালু উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে। পৃথিবীর কোনো শক্তি তাকে ধরতে পারবে না। আমার টিশা যাযাবর হয়ে গেছে। আমিও যাযাবর হয়ে যাব। আমি জানি আমাকেও এখন পালাতে হবে। টিশাকে খুঁজে বের করতে হবে।
টিশাদের বাসা থেকে বের হয়ে আমি আমার অনাথ আশ্রমে ফিরে গেলাম না। টিশার একজন মা আছে, আমার কেউ নেই। আমি জন্মের পর থেকে অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি, অনাথ আশ্রমের ছেলেমেয়েগুলো আমার সবকিছু। তাদের কাছ থেকে আমার বিদায় নেয়া দরকার কিন্তু মনে হয় বিদায় নেওয়া হবে না। আমি শহরের শেষ প্রান্তে হেঁটে হেঁটে গিয়ে একটা ধসে যাওয়া দালানে ঢুকে গেলাম। পুরোটা বিধ্বস্ত হয়ে আছে, ভাঙা যন্ত্রপাতিতে বোঝাই। আমি কোথাও ভাঙা সিঁড়ি কোথাও ভাঙা দেয়াল কোথাও জং ধরা যন্ত্রপাতি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। একটা ফাটলের পাশে বসে আমি পুরো ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করলাম। আমাকে খুঁজে খুঁজে যদি সেন্ট্রিরা এখানে চলে আসে আমি এখানে বসে দেখতে পাব, তখন সাবধানে পাশের দালানে সরে যাব। আমার এখন কিছুতেই ধরা পড়া চলবে না। কিছুতেই না।
আমি এর আগে কখনোই ঠান্ডা মাথায় কিছু চিন্তা করে কোনো কাজ করিনি–যখন যেটা ইচ্ছে হয়েছে তখন সেটা করেছি। এই প্রথমবার আমার খুব ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে কাজ করতে হবে।
আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে, পালানোর জন্য একটা মোটর বাইক দরকার। মোটর বাইকটা বেশি বড় হতে পারবে না তাহলে প্রাচীরের ছোট ফুটো দিয়ে সেটা বের করা যাবে না। মোটর বাইকে যথেষ্ট পরিমাণ পাওয়ার থাকতে হবে–সেটি অবশ্যি সমস্যা নয়–এক সময় তেল-গ্যাস দিয়ে পৃথিবী চলত তখন পাওয়ার নিয়ে সমস্যা ছিল। এখন তেল-গ্যাস দিয়ে পৃথিবী চলে না, ফিউশান পাওয়ার ব্যবহার শুরু করার পর সারা পৃথিবীর শক্তির সমস্যা মিটে গেছে। শুধুমাত্র পরিত্যক্ত ব্যাটারিতে যে পরিমাণ শক্তি জমা আছে সেটা দিয়েই এই পৃথিবীর মানুষ আরো দু-চারশ বছর টিকে থাকতে পারবে।
শুধু মোটর বাইক হলে হবে না, আমার কিছু শুকনো খাবার দরকার, তার সাথে খাবার পানি। এক-দুটো অস্ত্র হলে আরও নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। কোনো রকম ঝামেলা তৈরি না করে কীভাবে এগুলো জোগাড় করা যায় আমি চিন্তা করতে থাকি।
অনেকক্ষণ চিন্তা করেও কোনো রকম ঝামেলা না করে এগুলো জোগাড় করার কোনো সহজ বুদ্ধি খুঁজে পেলাম না। তখন আমি অন্যভাবে চিন্তা করতে থাকলাম, বড় ধরনের ঝামেলা করেই কাজটা করা যাক। কিন্তু কাজটা যেন খুব দ্রুত শেষ করা যায়। সব শেষে অস্ত্র জোগাড় না করে প্রথমেই যদি অস্ত্রটা জোগাড় করি তাহলে সেই অস্ত্র দিয়ে শুকনো খাবার কিংবা পানি জোগাড় করা বিন্দুমাত্র কঠিন কাজ নয়। সেই অস্ত্র দেখিয়ে কারো কাছ থেকে একটা মোটর বাইক কেড়ে নেওয়া কোনো বড় ধরনের ঝামেলা নয়। আইন না ভেঙে এই কাজগুলো করা মোটেই সহজ নয়। কিন্তু যদি ঠিক করে ফেলি আইনটা যেহেতু ভাংতেই হবে সেটা ঠিকভাবেই ভাঙা হোক তাহলে সবকিছুই খুব সহজ। পুরো পরিকল্পনাটার একটাই সমস্যা, আমি এর আগে কখনো কোনো দিন আইন ভেঙে কিছু করিনি–আজ করতে হবে।
অস্ত্র জোগাড় করার কাজটা সবচেয়ে কঠিন হবার কথা কিন্তু আমার মনে হলো এই কাজটাই হবে সবচেয়ে সহজ। আমি আর টিশা কংক্রিটের প্রাচীরের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে অনেকবার শহরের মূল গেটের কাছে এসেছি, যে দৃশ্যটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে সেটি হচ্ছে গেটের সেন্ট্রি গেটে হেলান দিয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে বসে আছে। এই গেট কয়েক মাসেও একবারের জন্য ভোলা হয় কি না সন্দেহ, তাই সেন্ট্রির কোনো কাজ নেই। কাজেই আধা ঘুমন্ত একজন সেন্ট্রির কাছ থেকে আচমকা একটা অস্ত্র কেড়ে নেওয়া কঠিন হওয়ার কথা নয়। তবে আমার চেহারায় পনেরো বছর বয়সের একটা ছেলের চেহারার ছাপ আছে, সেই ছাপটি রাখা যাবে না। কালিঝুলি মেখে প্রথমে চেহারার মাঝে একটা বীভৎস ভাব আনতে হবে।
কীভাবে পুরো পরিকল্পনাটা কাজে লাগানো হবে সেটি ঠিক করে নেবার পর আমি কাজে লেগে গেলাম। ধসে যাওয়া বিল্ডিংটা খুঁজে খুঁজে কিছু কালিঝুলি বের করে মুখে লাগাতে থাকি। চোখের নিচে, গালে এবং মুখটা ঘিরে কালো রঙের একটা আস্তরণ দিয়ে চেহারার মাঝে একটা ভয়ংকর ভাব ফুটিয়ে আনি। খুঁজে এক টুকরো কটকটে লাল রঙের কাপড়ের টুকরো পেয়ে গেলাম, সেটা মাথায় বেঁধে নিলাম, আয়না নেই বলে নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলাম না কিন্তু আমি অনুমান করতে পারছিলাম এখন আমার মোটামুটি একটা ভয়ংকর দর্শন চেহারা হয়েছে।
আমি তখন সাবধানে বিল্ডিং থেকে বের হয়ে কংক্রিটের প্রাচীরের দিকে ছুটতে থাকি। প্রাচীরের কাছাকাছি পৌঁছে কংক্রিটের টুকরোগুলোর আড়ালে থেকে গেটের দিকে এগোতে থাকি। গেটের কাছাকাছি পৌঁছে আমি মাথা তুলে উঁকি দিলাম। যা ভেবেছিলাম তাই, সেন্ট্রি গেটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে, অস্ত্রটা দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখেছে।