“ম্যাপ?”
“হ্যাঁ, এখান থেকে সোজা উত্তরে গেলে একটা বনভূমি পাবার কথা। সেখানে একটা হ্রদও আছে।”
আমি নিঃশব্দে বসে রইলাম। টিশা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি তোমাকে কেন এসব কথা বলছি জানি না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “মনে হয় সব মানুষেরই কথা বলার একজন মানুষ থাকতে হয়। তুমি ছাড়া আমার কথা বলার কোনো মানুষ নেই তাই তোমাকে বলছি। কাজটা ঠিক হলো কি না বুঝতে পারছি না।”
ঠিক তখন খুট করে দরজা খুলে টিশার মা ঘরে ঢুকল। আমাকে দেখে একটু ভুরু কুঁচকে তাকাল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “টিশা আজকে কাজে যায়নি। তাই একটু দেখতে এসেছিলাম। এখন যাই।”
টিশার মা বলল, “বসো। এক কাপ পানীয় খেয়ে যাও। উত্তেজক পানীয়, তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের ভালো লাগবে।”
আমি বললাম, “আরেক দিন খাব। আজকে যাই।”
“টিশা কেন কাজে যায়নি বলেছে?”
আমি কী উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না। ইতস্তত করে বললাম, “না মানে, কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত
“হ্যাঁ। সব সময়েই কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু কী নিয়ে ব্যস্ত আমি বুঝি না। সব সময়ে মেয়েটাকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকি।”
আমি আর কোনো কথা না বলে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম। টিশা আমাকে চলন্ত সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল। টিশাদের বারো তলা দালান থেকে বের হয়ে আমি যখন সরু একটা রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছি তখন আমার পাশ দিয়ে চারজন সশস্ত্র সেন্ট্রি হেঁটে গেল। আমি তখনো বুঝতে পারিনি তারা টিশাকে ধরে নিয়ে যেতে যাচ্ছে। কমিউনের কার্যকরি পরিষদে দুপুর বেলা টিশাকে ডিটিউন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া হয়েছে।
.
ঠিক কী কারণ জানা নেই সেই রাতটি আমি বিচিত্র দুঃস্বপ্ন দেখে ছটফট করে কাটিয়ে দিয়েছি। পরদিন ভোরে গিয়ে দেখি আমাদের কর্মী বাহিনী কাজ না করে এখানে-সেখানে জটলা করে নিচু গলায় কথা বলছে। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি জান না? টিশাকে ডিটিউন করার জন্য ধরে নিয়ে গেছে।”
আমার মাথাটা ঘুরে উঠল। মনে হলো আমার পুরো জগৎটি মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে গেল। চোখের সামনে একটা দৃশ্য ফুটে উঠল, টিশা একটা মপ নিয়ে নর্দমার ময়লা পানি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, চোখের দৃষ্টি স্থির, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। আমি তাকে ডাকছি সে আমার দিকে ঘুরে তাকাচ্ছে না, যখন ঘুরে তাকাচ্ছে তখন আমাকে চিনতে পারছে না। মনে হলো আমার বুকের ভেতর কিছু একটা তছনছ হয়ে যাচ্ছে।
ছেলেটি আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল, বলল, “দেখো রিহি, তোমার নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগছে, আমরা দেখেছি তুমি আর টিশা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলে কিন্তু কী করবে, মেনে নাও। তা ছাড়া আরো একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, তুমি নিজেও কিন্তু বিপদে আছ। টিশার পর যদি তোমাকে নিয়ে টানাটানি করে…”
ছেলেটি কথা বলে যাচ্ছিল, আমি কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল ছুটে বের হয়ে যাই কিন্তু আমাদের জেনারেটর ঘরের দরজা তালা মেরে দিয়েছে। কাজ শেষ হবার আগে বের হবার কোনো উপায় নেই।
আমি কীভাবে সারাটি দিন কাটিয়েছি আমি নিজেও জানি না। বিকেলে দরজা খুলে দেওয়ামাত্র আমি বের হয়ে ছুটতে থাকি। টিশাদের বারো তলা বিল্ডিংয়ের নিচে চলন্ত সিঁড়ির উপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে আমি আটতলায় টিশাদের ফ্ল্যাটে হাজির হলাম, দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। জানালার কাছে টিশার মা পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দরজায় শব্দ শুনে টিশার মা ঘুরে আমার দিকে তাকাল।
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “টিশা টিশা–”
টিশার মা বলল, “টিশা নাই। চলে গেছে।”
“কোথায় চলে গেছে?”
“আমি জানি না। কাল তুমি চলে যাবার পর চারজন সেন্ট্রি এসে তাকে ধরে নিয়ে গেছে। টিশা নাকি খুব ভয়ংকর একটা অপরাধ করেছে সেজন্য তাকে ডিটিউন করে দেবে।” টিশার মা এক মুহূর্তের জন্য থামল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “যাদেরকে ডিটিউন করা হয় তাদেরকে শেষবারের মতো তার আপনজনদের সাথে দেখা করার জন্য পাঠানো হয়। টিশাকেও পাঠিয়েছিল। তখন অনেক রাত।”
“টিশা-টিশা কী বলেছে?”
“কিছু বলেনি। সে যেন পালিয়ে যেতে না পারে তাই তার আঙুলে একটা ট্রাকিওশান লাগিয়ে দিয়েছিল। বাম হাতের কড়ে আঙুলে। লাল রঙের ট্রাকিওশান। বাইরে সেন্ট্রিরা অপেক্ষা করছে, ঘরের ভেতরে আমি আর টিশা।”
আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বললাম, “তখন?”
“তখন টিশা বলল, মা আমাকে একটা ধারালো চাকু দাও। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? টিশা বলল আমাকে জিজ্ঞাসা কোরো না। আমি তাকে একটা চাকু দিলাম। সেই চাকু নিয়ে সে তার ঘরে ঢুকে গেল। ঘরে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। বাইরে থেকে আমি শুধু একবার একটা যন্ত্রণার আর্তচিৎকার শুনতে পেলাম।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর?”
শেষ রাতে সেন্ট্রিরা টিশাকে নিতে এল। তার ঘরে ধাক্কা দিল। কেউ দরজা খুলল না। তখন তারা ধাক্কা দিয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতরে টিশা নেই। টেবিলের উপর ট্রাকিওশান লাগানো তার বাম হাতের কড়ে আঙুলটি পড়ে আছে। ট্রাকিওশানটা সিগনাল দিয়ে যাচ্ছে। আমার টিশা তার বাম হাতের কড়ে আঙুল কেটে ট্রাকিওশন আলাদা করে জানালার পাইপ বেয়ে নেমে গেছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না।” টিশার মা আমার দিকে অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তুমি জান বিহি, আমার মেয়ে টিশা কোথায়?”