কমবয়সী সেন্ট্রি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, ডিটিউন করে রেখে দেওয়া উচিত ছিল।”
টিশা কোনো কথা বলল না, খুব লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
০৫. পরদিন টিশা কাজে এল না
পরদিন টিশা কাজে এল না। আমাদের মতো মানুষদের কাজে না আসা খুব গুরুতর ব্যাপার, কেন আসেনি তার একশ রকম কৈফিয়ত দিতে হয়। কৈফিয়ত পছন্দ না হলে নানারকম উপদেশ দেওয়া হয়, সেই উপদেশ শাস্তি থেকেও ভয়ংকর। উপদেশে কাজ না হলে সত্যিকারের শাস্তি দেওয়া হয়–শাস্তিটা কী ধরনের সে সম্পর্কে আমরা শুধু ভাসা ভাসা শুনেছি; সঠিক ধারণা নেই। শুধু এটুকু জানি শাস্তি দেওয়ার পর কেউ ঠিক হয়ে যায়নি, এরকম কোনো উদাহরণ নেই।
।তাই টিশা যখন কাজে এল না আমি তখন দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমরা অনেকে একসাথে কাজ করি, তাই ব্যাপারটা অন্য কারো চোখে পড়েনি। টিশা একা একা থাকে, সে যে আজ কাজে আসেনি সেটা কেউ লক্ষ করবে না আমি আগেই জানতাম।
সারাটি দিন আমি এক ধরনের দুশ্চিন্তা নিয়ে কাটালাম। বিকেল বেলা কাজ শেষ হওয়ামাত্র আমি টিশাদের বাসায় হাজির হয়েছি। বারো তলা বাসা, আটতলার একটা ছোট ফ্ল্যাটে টিশা তার মাকে নিয়ে থাকে। আমি আগে এক-দুইবার তাদের ফ্ল্যাটে এসেছি। টিশার মা অনেকটা টিশার মতোন, চুল ছোট করে কাটা, খুব কম কথা বলে, চোখের দৃষ্টি কেমন জানি তীব্র।
দরজায় শব্দ করতেই টিশা দরজা খুলে দিল, বলল, “এসো। ভেতরে এসো রিহি।” তার কথা শুনে মনে হলো সে যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
আমি ভেতরে ঢুকলাম। টিশা দরজা বন্ধ করে বলল, “আমার মা এখনো বাসায় আসেনি। কিছুক্ষণের মাঝে চলে আসবে। মা চলে আসার আগে আমি তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই।”
“কী কথা?”
রান্নাঘরে খাবার টেবিলের পাশে চেয়ারটাতে বসার আগেই টিশা বলল, “তোমার মনে আছে মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানোর জন্য লুক আর হুনাকেও নিয়ে গিয়েছিল, তাদের আর দেখা যায়নি?”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “মনে আছে।”
টিশা বলল, “তাদের কী হয়েছে আমি বের করেছি।”
আমি ভয়ানকভাবে চমকে উঠলাম, জিজ্ঞেস করলাম, “কী বের করেছ?”
টিশা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কিছু-একটা দেখে আমার দিকে ঘুরে তাকাল, “লুক আর হুনার কী হয়েছে।”
“কী হয়েছে?”
“তাদের মাথায় বাই-ক্রেনিয়াল লাগিয়েছে।”
“বাই-ক্রেনিয়াল? সেটা কী?”
“ক্রেনিয়াল লাগালে মাথার ভেতরে শুধু তথ্য দেওয়া যায়। বাই ক্রেনিয়াল হলে দুটো ইন্টারফেস লাগানো হয়। তখন যে রকম তথ্য দেয়া যায় সে রকম তথ্য নেওয়া যায়।”
“তারা এখন কোথায়?”
“এত দিন এখানে হাসপাতালে ছিল। আজ ভোরে একটা কনভয়ের সাথে তাদেরকে অন্য শহরে পাঠিয়ে দিয়েছে।”
“তারা যেতে রাজি হয়েছে?”
টিশা হাসার ভঙ্গি করল, সেই হাসিতে বিন্দুমাত্র আনন্দ নেই। বলল, “তোমার ধারণা তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য আছে? নেই। আমি যতদূর জানি, বাই-ক্রেনিয়াল লাগানোর পর তাদের জ্ঞান ফেরেনি। কিংবা জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টাও করা হয়নি।”
আমি নিজের ভেতর এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি, আতঙ্কটুকু ঠিক কী নিয়ে বুঝতে পারছিলাম না। টিশাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কেমন করে এত কিছু জেনেছ?”
টিশা জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকাল, তারপর আবার মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল, বলল, “কাজটা খুব সহজ ছিল না। আমি অনেক দিন থেকে জানার চেষ্টা করছিলাম। লুক আর হুনার মায়ের সাথে কথা বলেছি। কুশ, মিকি আর ক্রিটনের সাথে কথা বলেছি। হাসপাতালের লোকজনের সাথে কথা বলেছি। আর—”
“আর কী?”
“কিছু বেআইনি কাজ করেছি।”
আমার বুক কেঁপে উঠল, “কী বেআইনি কাজ?”
“তাদের গোপন ভিডিও ডাউনলোড করেছি।”
“কেমন করে করেছ?”
“তোমাকে বললে তুমি বুঝবে না। কেমন করে করতে হয় আমি জানি। ভিডি টিউবে বই পড়ে শিখেছি। আমার মাথায় ক্রেনিয়াল নেই, তাই আমাকে কেউ সন্দেহ করে না। সবাই ধরে নিয়েছে আমি কিছু জানি না। আসলে আমি অনেক কিছু জানি।”
আমি এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে টিশার দিকে তাকিয়ে রইলাম। টিশা বলল, “কী হলো, তুমি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?”
“তুমি কি জান তুমি যেটা করছ সেটা কত বিপজ্জনক?”
“জানি।”
“যদি তুমি ধরা পড় তাহলে তোমার কী হবে তুমি জান?”
“জানি। আমাকে ডিটিউন করে দেবে।”
“তাহলে?”
“তাহলে কী?”
“তাহলে তুমি এত বড় ঝুঁকি কেন নিচ্ছ?”
টিশা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি এই শহরে আর থাকব না।”
আমি কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলতে পারলাম না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বললাম, “তুমি কোথায় যাবে?”
“আমি যাযাবর হয়ে যাব।” টিশা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল অবিশ্বাস্য এক ধরনের হাসি।
“তুমি যাযাবর হয়ে যাবে?”
“হ্যাঁ।”
“শহর থেকে তুমি বের হবে কেমন করে? তুমি জান না গেট সব সময় বন্ধ থাকে? সেন্ট্রিরা চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দেয়?”
“আমি গেট দিয়ে বের হব না।”
“তাহলে কোন দিক দিয়ে বের হবে?”
“তোমার মনে নেই, প্রাচীরের নিচে একটা ফাঁক আছে? আমি সেই ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যাব।”
“তারপর? তুমি হেঁটে হেঁটে কতদূর যাবে? পাঁচ কিলোমিটার যাবার আগে তোমাকে ধরে নিয়ে আসবে।”
“আমি হেঁটে হেঁটে যাব না, আমি মোটর বাইকে যাব। তুমি ভুলে গেছ আমার একটা মোটর বাইক আছে।”
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। অবাক হয়ে টিশার দিকে তাকিয়ে রইলাম। টিশা বলল, “আমি তোমাকে বলিনি, তাহলে তোমাকেও বিপদে ফেলা হবে। আমি মোটর বাইকে পানি খাবার জমা করেছি। কষ্ট করে একটা অস্ত্র জোগাড় করেছি। কিছু যন্ত্রপাতি ওষুধপত্র, পুরানো একটা ম্যাপ–”