কমান্ড্যান্ট যাযাবর মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী চাও?”
মানুষটি বলল, “আমি কিছু চাই না।”
“তাহলে কেন এসেছ?”
“এমনি।”
কমান্ড্যান্ট কঠিন গলায় বলল, “এমনি কেউ আসে না।”
যাযাবর মানুষটি সহৃদয় ভঙ্গিতে হাসল, বলল, “আমি আসি!”
“কেন?”
“আমি ঘুরে বেড়াই। ঘুরে ঘুরে দেখি। দেখাতেই আমার আনন্দ। দূর থেকে দেখলাম তোমাদের শহর, তাই দেখতে এসেছি।”
কমান্ড্যান্ট কেমন যেন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, বলল, “আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না।”
যাযাবর মানুষটা আবার সহৃদয় ভঙ্গিতে হাসল, বলল, “তোমাকে আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে না। আমি তোমাকে আমার কথা বিশ্বাস করতেও বলব না।”
কমান্ড্যান্ট মুখ আরো শক্ত করে বলল, “তুমি আসলে দস্যুদলের গুপ্তচর। তুমি আমাদের শহরের ভেতরে খোঁজ নিতে এসেছ।”
মানুষটা হাসি হাসি মুখে বলল, “তুমি যদি তাই বিশ্বাস করতে চাও, আমার কোনো সমস্যা নেই।”
“তোমাকে আমরা অ্যারেস্ট করব।”
“করতে চাইলে করো। আমার জন্য সেটাও হবে এক ধরনের অভিজ্ঞতা। আমি কখনো কোথাও অ্যারেস্ট হইনি।”
কমান্ড্যান্ট তখন কেমন যেন কথা বলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তুমি কী চাও ঠিক করে বলো।”
বিচিত্র মানুষটা প্রথমবার গম্ভীর মুখে বলল, “আমি কিছু চাই না। যদি অনুমতি দাও তোমাদের শহরটা দেখব। যদি না দাও, এখানে এক-দুইদিন বসে থাকব, রাত্রে আগুন জ্বালিয়ে গিটার বাজিয়ে তোমাদের গান শোনাব। যদি সেটাও না চাও চলে যাব।” মানুষটা এক মুহূর্ত থেমে বলল, “আর, তুমি যদি চাও তাহলে—”
“তাহলে কী?”
“আমি তোমাদের ভাঙা অকেজো গাড়ি বাইক লরি এসব ঠিক করে দিতে পারি। আমি খুব ভালো গাড়ির মেকানিক।”
কমান্ড্যান্ট মাথা নাড়ল, “তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের ক্রেনিয়াল লাগানো মানুষ আছে। যে কোনো বিষয়ে আমরা তথ্য মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিতে পারি।”
বিচিত্র মানুষটা কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে হাসতে থাকে। কমান্ড্যান্ট ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কী হলো? তুমি এভাবে হাসছ কেন?”
“এমনি! তোমাদের ক্রেনিয়ালের বাইরে অনেক তথ্য আছে! যেগুলো অভিজ্ঞতা থেকে জানতে হয়। ক্রেনিয়াল লাগানো ইঞ্জিনিয়াররা যে গাড়ি ঠিক করতে পারেনি সেরকম একটা গাড়ি নিয়ে এসো, আমি তোমাকে দেখাই।”
“তোমাকে কিছু দেখাতে হবে না।” কমান্ড্যান্ট কিছুক্ষণ কিছু একটা চিন্তা করে বলল, “ঠিক আছে, তোমাকে আমি চব্বিশ ঘণ্টা এখানে থাকার অনুমতি দিলাম, কিন্তু তোমাকে কয়েকটা আদেশ মানতে হবে।”
“কী আদেশ?”
“তুমি এখানেই বসে থাকবে, শহরের ভেতরে ঢুকতে পারবে।”
“ঢুকব না।”
“গানবাজনা হইহুল্লোড় চলবে না।”
“ঠিক আছে।”
“তোমার এই ঘেয়ো কুকুর আর প্যাঁচা–”
“এটা প্যাচা না। এটা বাজপাখি।”
“যাই হোক, এই জন্তু-জানোয়ার শহরের সীমানার বাইরে রাখবে। আমি চাই না এগুলো এখানে রোগ-জীবাণু আর ব্যাকটেরিয়া ছড়াক।”
মানুষটি হেসে ফেলল। জিজ্ঞেস করল, “আর কিছু?”
“শহরের মানুষের সাথে কোনো গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর চলবে। কোনো ষড়যন্ত্র কোনোরকম গুজব ছড়ানো চলবে না।”
মানুষটাকে এবারে একটু দুশ্চিন্তিত দেখাল, বলল, “তার মানে আমি কারো সাথে কথা বলতে পারব না?”
“কথা বলতে পারবে কিন্তু গুজব ছড়াতে পারবে না।”
“কিন্তু কোনটাকে তোমরা কথাবার্তা বলবে আর কোনটাকে তোমরা গুজব বলবে, আমি সেটা কেমন করে বুঝব?”
“তোমার বুঝতে হবে না। তোমার সব কথাবার্তা আমরা মনিটর করব। যখন দেখবে তোমাকে ঘাড় ধরে বের করে দিচ্ছি, বুঝবে তুমি গুজব ছড়াচ্ছ।”
মানুষটি মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”
০৪. মানুষের ভিড় একটুখানি কমতেই
মানুষের ভিড় একটুখানি কমতেই টিশা আমাকে নিয়ে যাযাবর মানুষটার কাছে গেল। যাযাবর মানুষটি তখন একটা ভাঙা দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে। তার অনেকগুলো পকেটের একটা পকেট থেকে ছোট এক টুকরো গাছের ডাল বের করেছে। অন্য পকেট থেকে একটা ছোট চাকু, তারপর চাকু দিয়ে কাঠের ডালটা চেঁছে চেঁছে একটা দাবার গুটি তৈরি করার চেষ্টা করতে থাকে।
আমাদের দেখে মানুষটা মাথা তুলে তাকিয়ে একটু হাসল। দাড়ি গোঁফের ফাঁক দিয়ে ভালো দেখা যায় না, কিন্তু যেটুকু দেখা গেল মনে হলো মানুষটির দাঁতগুলো খুবই সুন্দর। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “শুভ বিকেল।”
আমি বললাম, “শুভ বিকেল।”
টিশা বলল “তোমার নাম কী?”
মানুষটা একটু অবাক হয়ে টিশার দিকে তাকাল, বলল, “নাম? আমার নাম?”
“হ্যাঁ।”
“কী আশ্চর্য! আমার যে একটা নাম ছিল আমি ভুলেই গেছি! কত দিন হয়ে গেল, কেউ আমাকে আমার নাম ধরে ডাকে না! আমি একা থাকি, একা ঘুরে বেড়াই, কে আমাকে আমার নাম ধরে ডাকবে!”
টিশা কী বলবে বুঝতে পারল না, একটা সহজ প্রশ্নের একরকম জটিল উত্তর হবে সে আশা করেনি। ইতস্তত করে বলল, “তোমার নিশ্চয়ই একটা নাম ছিল!”
“হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমার একটা নাম ছিল। আমার মা আমাকে ডাকত জিরন। এখন নিশ্চয়ই আমার নাম হবে যাযাবর জিরন। ছোট করে বলতে পার যাযারন!” মানুষটা নিজেই তার নতুন নামটা কয়েকবার উচ্চারণ করল, মনে হলো তার বেশ পছন্দ হলো। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “আমাকে তুমি যাযারন ডাকতে পার।”
টিশা বলল, “ঠিক আছে যাযারন, আমি তোমার কাছে জানতে চাই, তুমি যে বাইরে ঘুরে বেড়াও, তোমার কোনো বিপদ হয় না? বাইরে দস্যুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, বন্য পশু আছে, মাটিতে এতো রেডিয়েশান।”