তার ঘুম হল ছাড়াছাড়াভাবে, সারাক্ষণই স্নায়ু ছিল সজাগ, তাই একটুতেই ঘুম ভেঙে সে পুরোপুরি জেগে উঠছিল। তবুও ঘণ্টা দুয়েক পর সে খানিকটা সতেজ অনুভব করে। উঠে বসে সে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। এই দরজার অন্য পাশে রয়েছে সেই রহস্যময় জগৎ, সাবধানে তাকে সেই রহস্যের উন্মোচন করতে হবে। যন্ত্রপাতি নামিয়ে সে কাজ শুরু করে।
দরজাটি অনেকটা মহাকাশযানের দরজার মতো, মহাকাশের পুরোপুরি বায়ুশূন্য পরিবেশে যাবার আগে যেরকম একটা ছোট কুঠুরিতে ঢুকে সেটাকে সবকিছু থেকে আলাদা করে ফেলতে হয়, সেরকম। প্রথম দরজাটি খুলে সে একটা ছোট কুঠুরিতে ঢুকে বাইরের দরজা বন্ধ করে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ পুরোপুরি কেটে দেবার পরই শুধু পরবর্তী দরজাটি খোলা সম্ভব। এর ফলে বাইরের জগৎ থেকে কোনোকিছু ভিতরে আসতে পারলেও, ভিতর থেকে কিছু বাইরে যেতে পারবে না। বাইরে সেটা নিয়েই বড় সাবধান বাণী লেখা রয়েছে–ভিতর থেকে যেন একটি পরমাণুও বাইরে আসতে না পারে।
দরজার পরবর্তী স্তরটি আরো জটিল। বিদ্যুৎপ্রবাহ ছিল না বলে সেটা সম্পূর্ণ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু রিগার ব্যাগের হোট একটা জেনারেটর তাকে উদ্ধার করল। দ্বিতীয় স্তরটি থেকে তৃতীয় স্তরে যেতে তার পুরো তিন ঘণ্টা সময় বের হয়ে গেল। তৃতীয় স্তরের কাজটি তুলনামূলকভাবে সহজ। স্ক্রুগুলো খুলে হাতলে চাপ দিতেই দরজাটি খুব সহজে খুলে গেল। ভিতরে আলো জ্বলছে। রিগা দরজাটি উন্মুক্ত করে ভিতরে উঁকি দিল।
ঘরের ঠিক মাঝামাঝি অংশে কিছু জটিল যন্ত্রপাতির সামনে উবু হয়ে বসে আছে দুজন মানুষ, দরজা খোলার শব্দ শুনে মাথা ঘুরে তাকিয়েছে দুজন রিগার দিকে। রিগা চিনতে পারল দুজনকেই, একজন প্রফেসর ত্রিনি, আরেকজন প্রফেসর লিক। গত দু শ পনের বছরে তাঁদের চেহারার কোনো পরিবর্তন হয় নি। প্রফেসর ত্রিনি ভুরু কুঁচকে রয়েছেন, মনে হচ্ছে কোনো কারণে খুব বিরক্ত হয়েছেন, এগিয়ে এসে বললেন, ভিতরে আসতে কাউকে নিষেধ করেছি, তুমি জান না?
বাচনভঙ্গি ভিন্ন ধরনের। গত দু শ বছরে ভাষার বেশি পরিবর্তন হয় নি, কিন্তু বাচনভঙ্গি অনেকটুকু পাল্টেছে। পরিবর্তনটুক খুব সহজে রিগার কানে ধরা পড়ল।
প্রফেসর ত্রিনি আবার বললেন, তোমাকে তো আগে কখনো দেখি নি, কার সাথে তুমি কাজ কর?
রিগা কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, যন্ত্রপাতির মাঝে উবু হয়ে বসে থেকে প্রফেসর লিক বললেন, ত্রিনি, দেখবে এস, ট্রনোট্রনে কোনো পাওয়ার নেই।
পাওয়ার নেই? কী বলছ তুমি। প্রফেসর ত্রিনি দ্রুত লিকের কাছে এগিয়ে গেলেন, বললেন, একটু আগেই তো ছিল।
তোমাকে আমি বলেছিলাম না, এই পাওয়ার সাপ্লাইগুলো একেবারে যাচ্ছেতাই। একট লোড বেশি হলেই ধসে যায়। এখন দেখ কী যন্ত্রণা–
প্রফেসর ত্রিনি মাথা চুলকে বললেন, তাই তো দেখছি। ভাবলাম পাওয়ার সাপ্লাইয়ে পয়সা নষ্ট করে লাভ কি।
এখন বোঝ ঠ্যালা, পুরোটা খুলে ওটা বের করে আনতে জানটা বের হয়ে যাবে না?
আমাকে দাও, আমি করছি। প্রফেসর ত্রিনি বড় একটা পাওয়ার কু-ড্রাইভার নিয়ে ঝুঁকে পড়লেন। রিগা যে কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, সেটা মনে হচ্ছে দুজনেই পুরোপুরি ভুলে গেছেন।
রিগা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডারে বড় বড় করে লেখা-১৯শে এপ্রিল, মঙ্গলবার। উপরে বড় একটা ঘড়িতে সময় দেখানো হচ্ছে, সকাল সাড়ে এগারটা—এই চতুষ্কোণ ঘরটিতে সময় স্থির হয়ে আছে এবং এই দু জন বিজ্ঞানী সেটা জানেন না। রিগা তার ঘড়ির দিকে তাকাল, এই ঘরটিতে পা দিয়েছে মিনিটখানেক পার হয়েছে, পৃথিবীতে এর মাঝে কত সময় পার হয়ে গেছে?
প্রফেসর ত্রিনি এবং লিক চতুষ্কোণ একটা বাক্সের মতো কি-একটা জিনিস খুলে টেনে বের করার চেষ্টা করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলেন, এবারে একটু বিরক্ত হয়ে রিগাকে বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে জখছ কী, একটু হাত লাগাও না।
রিগা একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, প্রফেসর ত্রিনি এবং প্রফেসর লিক, আপনাদের দুজনকে আমার খুব একটা জরুরি জিনিস বলার রয়েছে।
তার গলার স্বরের জন্যেই হোক বা দু শ পনের বছরের পরিবর্তিত বাচনভঙ্গির জন্যেই হোক, দুজনেই কেমন জানি একটু চমকে উঠলেন। তাঁদের চোখে হঠাৎ কেমন একটি আশঙ্কা ফুটে উঠল। ভালো করে রিগার দিকে তাকালেন প্রথমবারের মতো—কিছু-একটা অসঙ্গতি আঁচ করতে পারলেন দুজনেই। প্রফেসর লিক ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি কে? কেন এসেছ এখানে?
আমার নাম রিগা। আমি এখানে এসেছি একটা কৌতূহল মেটানোর জন্যে—
কী কৌতূহল? তোমার কথা এরকম কেন? কোন অঞ্চল থেকে এসেছ তুমি?
তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনারা কতক্ষণ আগে এই ঘরে ঢুকেছেন?
কেন?
আমি জানতে চাই–
এই আধা ঘণ্টার মতো হবে, প্রফেসর ত্রিনি ঘড়ির দিকে তাকালেন, এগারটার সময় ঢুকেছি, এখন সাড়ে এগারটা। কেন, কী হয়েছে?
বাইরে, এই আধা ঘণ্টা সময়ে অনেক কিছু হয়ে গেছে।
কী হয়েছে? কি?
দু শ পনের বছর সময় পার হয়ে গেছে।
কথাটি তারা বুঝতে পারলেন বলে মনে হল না, অবাক হয়ে দুজনে বিস্ফারিত চোখে রিগার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁদের চোখে প্রথমে অবিশ্বাস, তারপর হঠাৎ করে যোবা আতঙ্ক এসে ভর করে। প্রফেসর ত্রিনি ছুটে এসে রিগার কলার চেপে ধরেন, চিৎকার করে বলেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ, মিথ্যা কথা—