রিগা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকে। ভ্যানটি প্রচণ্ড গর্জন করে একটি অতিকায় শুঁয়োপোকার মতো পাথরে গর্ত করে নির্দিষ্ট দিকে এগুতে থাকে।
ল্যাবরেটরি ঘরের সামনে ভ্যানটি দাঁড় করিয়ে রিগা মাস স্পেকট্রোমিটারটি চালু করে। বাতাসে নিঃশাস নেবার উপযোগী যথেষ্ট অক্সিজেন রয়েছে। কিন্তু বিষাক্ত কোনো গ্যাস রয়েছে কী না জানা দরকার। তার কাছে অক্সিজেন মাস্ক রয়েছে, কিন্তু সেটা ব্যবহার করতে না হলে কাজকর্মে সুবিধে হয়। রিগা স্পেকটোমিটারটির স্ক্রিনে ভালো করে তাকায়, বিচিত্র কিছু গ্যাস রয়েছে, রেডনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি, কিন্তু বিষাক্ত কোনো গ্যাস নেই। রিগা জানালা অল্প একটু খুলে নিঃশ্বাস নেয়, একটু ভ্যাপসা গন্ধ বাতাসে, কিন্তু খানিকক্ষণেই অভ্যাস হয়ে যাবার কথা।
ল্যাবরেটরির সামনে দু শ বছরের ভারি পুরানো ওক কাঠের দরজা। সম্ভবত সে সময়ে এ রকম দরজার প্রচলন ছিল। দরজার উপর ধুলায় ধূসর একটি সাইনবোর্ড, সেখানে বড় বড় করে লেখা, প্রবেশ নিষেধ, আইন অমান্যকারীকে তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড।
রিগা চারদিকে তাকায়, একসময় নিশ্চয়ই আশেপাশে কড়া পাহারা ছিল, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে প্রহরীরা তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্যে অপেক্ষা করত। দু শ পনের বছর পর সেই প্রহরীরা নেই, কিন্তু অন্য কোনো ধরনের সাবধানতা এখনো অবশিষ্ট রয়েছে কী না কে জানে? রিগা সাবধানে পরীক্ষা করে কিছু না পেয়ে হাতের রাস্তার দিয়ে দরজাটি খুলে ফেলল।
ভিতরে একটা লম্বা করিডোর। হাতের আলোটা উপরে তুলে রিগা চারদিকে তাকাল। দূরে একটা দরজা। করিডোরের দেয়ালে কিছু ছবি, কিছু পুরানো কম্পিউটারের মনিটর। ধুলায় সব কিছু ঢেকে আছে। রিগা সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যায়। সমস্ত ল্যাবরেটরিতে সমাধিক্ষেত্রের নীরবতা।
করিডোরের শেষ মাথার দরজাটিও বন্ধ। বাইরে আরেকটা সাইনবোর্ড, সেখানে আবার বড় বড় করে সাবধান বাণী লেখা। ভিতরে প্রবেশ নিষেধ এবং প্রবেশ করার চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড পাশে একটি নোটিশ বোড়, রিগা সাবধানে ধুলা ঝেড়ে ভিতরে তাকাল। ভিতরে একটা ছবি। চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের দুজন হাসিখুশি মানুষ একটি চতুষ্কোণ বাক্সের মতো জিনিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিচে লেখা, প্রফেসর ত্রিনি ও প্রফেসর লিক তাদের সময় অপবলয় ক্ষেত্রের সামনে। দুজনই নিরীহ এবং হাসিখুশি চেহারার মানুষ, প্রফেসর ত্রিনির সামনের চুল হালকা হয়ে এসেছে, প্রফেসর লিকের মুখে বেমানান গোঁফ।
রিগা দীর্ঘ সময় ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই দুজন সেই রহস্যময় বিজ্ঞানী, যাঁরা নিজেদের অগোচরে সমস্ত পৃথিবীকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিলেন, যাঁরা বিস্ময়কর এক সুড়ঙ্গপথে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরে ছিটকে পড়েছেন। রিগা আজ আবার পরীক্ষা করবে সেই বিস্ময়কর সুড়ঙ্গপথ। সে নিজেও কি ছিটকে পড়বে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরে? সেও কি সমস্ত পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে টেনে নিয়ে যাবে নিজের অগোচরে?
করিডোরের দরজাটি ভালো করে পরীক্ষা করে রিগা খুব সহজেই তার ব্লাস্টারটি দিয়ে খুলে ফেলল। ভিতরে বিশাল একটা হলঘরের মতো, চারদিকে অসংখ্য অতিকায় যন্ত্রপাতি, আবছা আলোতে ভুতুড়ে এক জায়গার মতো লাগছে। রিগা সাবধানে পা ফেলে ভিতরে এগিয়ে যায়। হলঘরের মাঝামাঝি চতুষ্কোণ বাক্সের মতো ছোট একটা ঘর। চারদিক থেকে অসংখ্য যন্ত্রপাতি, নানারকম তার এবং কেবল এই ঘরের মাঝামাঝি এসে জমা হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে এটাই হচ্ছে সময়ের অপবলয় ক্ষেত্র। ঘরটা ঘুরে ঘুরে রিগা খুব ভালো করে পরীক্ষা করল। এক পাশে গোলাকার একটা দরজা, অসংখ্য স্ক্রু দিয়ে সেটি শক্ত করে লাগানো। দেখে মনে হয় এই স্ক্রুগুলো পরে লাগানো হয়েছে। রিগা ভালো করে দরজাটি পরীক্ষা করল। মাঝামাঝি জায়গায় বিভিন্ন ভাষায় ছোট একটি ঘোষণাপত্র লাগানো হয়েছে, তাতে লেখা এই দরজার অন্য পাশে যা রয়েছে সেটি এ পাশের কারো জানার কথা নয়। অন্য পাশের একটি পরমাণও যদি পৃথিবীর এই অংশে উপস্থিত হয় সমস্ত পৃথিবী ধ্বংসের সম্ভাবনা রয়েছে। আপনি যে ই হয়ে থাকুন এই দরজা স্পর্শ না করে ফিরে যান।
রিগা তার ব্যাগ নিচে রেখে কাছাকাছি একটা জায়গায় পা মুড়ে বসে পড়ে। সে কি দরজায় স্পর্শ না করে ফিরে যাবে? সেটি তো হতে পারে না, এত কষ্ট করে এতদূর এসে সে তো রহস্য ভেদ না করে যেতে পারে না। পৃথিবী ধ্বংস হোক সেটা সে চায় না, কিন্তু প্রফেসর ত্রিনি এবং লিক তত পৃথিবী ধ্বংস না করেই এই রহস্যের সৃষ্টি করেছেন, সে কেন পারবে না?
রিগা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে দরজাটি লক্ষ করে। ছোট ছোট করে অনেক কিছু লেখা রয়েছে, গোলাকার দরজাটি দেখেও কিছু আশা করা যায়। এই দরজাটি কয়েকটা স্তরে ভাগ করা রয়েছে। ভিতরের একটি পরমাণুকেও বাইরে আসতে না দিয়ে একজন মানুষের ভিতরে ঢোকা সম্ভব—তার জন্যে সে রকম প্রস্তুতি নিতে হবে। অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ কাজটি শুরু করার আগে রিগা একটু বিশ্রাম নিয়ে নেবে ঠিক করল।
ব্যাগ থেকে কিছু শুকনো খাবার বের করে খেয়ে নিয়ে রিগা দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজলে।
পাহাড়ের নিচে দুই হাজার ফুট পাথরের আড়ালে সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এত বড় একটা রহস্যের মুখোমুখি এসে চট করে চোখে ঘুম আসতে চায় না, কিন্তু সমস্ত দিনের পরিশ্রমে শরীর এত ক্লান্ত হয়েছিল যে সত্যি একসময় তার চোখ বুজে এল।