(এক) আজ থেকে প্রায় দু শ বছর আগে পাশাপাশি দুটি শহরে ত্রিনি ও লিক নামে দুজন মানুষের জন্ম হয়েছিল। এ
(দুই) প্রায় সমবয়সী এই দুজন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন।
(তিন) তাঁদের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল সময়ের অপবলয়।
(চার) প্রায় দু শ পনের বছর আগে ত্রিনি ও লিক সময়ের অপবলয়সংক্রান্ত একটি পরীক্ষা করার চেষ্টা করেন। পরীক্ষাটি ঠিকভাবে শেষ হয় নি।
(পাঁচ) তাঁরা যেখানে পরীক্ষাটি করেছিলেন, সেখানে, সম্ভবত একটা বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। সম্ভবত সেখানে তাঁরা একটি সুড়ঙ্গের মতো সৃষ্টি করেন, যেটি বিশ্বব্রহ্মায়ে বাইরের সাথে যোগাযোগ করে দেয়।
(ছয়) ত্রিনি ও লিক সেই সুড়ঙ্গপথে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরে ছিটকে পড়েন, কারণ তাঁদের কখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি।
(সাত) এই সুড়ঙ্গের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয়, কারণ সমস্ত পৃথিবী এই পথ দিয়ে গলে বের হয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।
বিস্ময়কর এই তথ্য রিগার কৌতূহলকে নিবৃত্ত না করে আরো বাড়িয়ে দেয়। সত্যিই কি ত্রিনি ও লিক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরের সাথে একটি সুড়ঙ্গমুখ খুলে দিয়েছেন? সত্যিই কি সেই পথে বেরিয়ে যাওয়া যায়? সত্যিই কি পুরো পৃথিবী এই পথে বের হয়ে যেতে পারে?
এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার একটিমাত্র উপায়—ত্রিনি ও লিক যেখানে পরীক্ষাটি করেছিলেন, সেটি খুঁজে বের করা।
রিগার জন্যে সেটা খুঁজে বের করা খুব কঠিন হল না। দেখা গেল, ত্রিনি ও লিক সেই পরীক্ষাটি করেছিলেন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একটি কক্ষে। সেই কক্ষটি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে তাকে ঘিরে প্রায় চল্লিশ বর্গমাইল এলাকার উপর দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পাথর এবং কংক্রিট ঢালা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের হ্রদের তীরে যে ছোট পাহাড়টি বসন্তকালে অসংখ্য ফুলে ঢেকে যায়, সেটি একটি কৃত্রিম পাহাড়, এই তথ্যটি পৃথিবীতে রিগা ছাড়া আর কেউ জানে না। পাহাড়ের প্রায় হাজার দুয়েক ফুট নিচে একটি ছোট বিজ্ঞানাগারে ত্রিনি ও লিক একটি অসাধারণ পরীক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই পরীক্ষাটি কী ধরনের বিপর্যয়ের সূত্রপাত করেছিল আজ রিগা সেই রহস্য ভেদ করতে যাচ্ছে।
এর জন্যে রিগা প্রায় পাঁচ বছর প্রস্তুতি নিয়েছে। প্রথমত সে তার কাজ বদল করে উত্তরাঞ্চলের সেই শহরে চলে এসেছে। শহরের এক পাশে হ্রদ, অন্য পাশে ছোট পাহাড়টি গ্রীষ্মকালে অনেক ভ্রমণবিলাসী মানুষকে আকর্ষণ করে, কিন্তু এমনিতে সারা বছর বেশ নিরিবিলি। ছোট এই শহরে দ্রোন ভাষায় অভিজ্ঞ কম্পিউটার প্রোগ্রামারের উপযোগী লেননা কাজ নেই বলে সে পাওয়ার সাপ্লাইয়ের একটি কারখানায় কাজ করে। অবসর সময়ে সে শব্দতরঙ্গ দিয়ে ঘনত্ব মাপার একটা যন্ত্র তৈরি করেছে, সেই যন্ত্রটি দিয়ে ধীরে ধীরে সে পুরো পাহাড়টি পর্যবেক্ষণ করেছে। পাহাড়ের নিচে কোথায় সেই রহস্যময় গবেষণাগারটি লুকিয়ে রয়েছে সেটাও খুঁজে বের করেছে। সেই গবেষণাগারে পৌঁছানোর জন্যে পাহাড়ের কোন অংশ দিয়ে যাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ, সেটাও নির্ধারণ করেছে। পাহাড় কেটে একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করে ভিতরে ঢুকে যেতে কী ধরনের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন অনুমান করার চেষ্টা করেছে। তারপর সেইসব যন্ত্রপাতি দিয়ে এই ভ্যানটি তৈরি করেছে। নিরীহদর্শন এই ভ্যানটির ভিতরে রয়েছে চারটি শক্তিশালী কুরু ইঞ্জিন। প্রয়োজনে সামনের অংশটি খুলে সেখান থেকে কার্বন হীরের পাথর কাটার একটা অতিকায় উিল বের হয়ে আসে। শক্তিশালী ইঞ্জিনের প্রচণ্ড ঘূর্ণনে সে ডিল পাথর কেটে পুরো ভ্যানটাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে যাবে। ভ্যানের মাঝে রয়েছে শক্ত পাম্প, সামনের কাটা পাথর সেটি সরিয়ে আনে পিছনে। পাহাড়ের যে অংশ দিয়ে রিগা ভিতরে ঢুকবে, সে অংশটি লতাগুলা দিয়ে ঢাকা। কেউ সেদিকে যায় না, যাবার রাস্তাও নেই। কেউ সহজে জানতে পারবে না যে রিগা এদিক দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেছে। প্রবেশপথ ঢেকে যাবে কাটা পাথরে, বসন্তের বৃষ্টিতে নৃতল গাছগাছালি গজিয়ে ঢেকে ফেলবে সেই জায়গা।
হ্রদের তীর দিয়ে ঘুরে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছাতেই রিগা তার ভ্যানের হেড লাইট নিভিয়ে দিল। তার হিসেবমতো চাঁদ ডুবে গিয়ে চারদিকে এখন গাঢ় অন্ধকার। রিগা খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নেয় যে কেউ তার পিছু নেয় নি। তারপর অন্ধকারেই ভ্যানটিকে চালিয়ে গাছগাছালির ভিতর দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে এনে হাজির করে। আজকের অভিযানের প্রথম অংশ পরিকল্পনামতোই কোনো সমস্যা ছাড়া শেষ হয়েছে।
রিগা সাবধানে ভ্যান থেকে নেমে তার ইনফ্রারেড চশমাটি পরে নেয়, সাথে সাথে অন্ধকার দূরীভূত হয়ে চারদিকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। রিগা সাবধানে চারদিকে তাকায়, কোথাও কিছু নেই, শুধুমাত্র একটি নিশাচর রাকুন খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা গাছের গুড়িতে লুকিয়ে যায়। রিগা কয়েক পা এগিয়ে যায়, অনেক ধরনের যন্ত্রপাতিতে বোঝাই বলে ভ্যানটি মাটির উপরে উঠতে পারে না, সময় সময় চাকার গর্ত রেখে আসে। তাকে এখন সাবধানে এইসব চাকার দাগ মুছে ফেলতে হবে। রিগা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে তার কাজ শুরু করতে এগিয়ে যায়।
হিসেব মতন ভোর পাঁচটা দশ মিনিটে রিগা তার ভ্যানটি চালু করল। ঠিক এই সময়ে শহরের বড় জেনারেটরটি চালু করা হয়। তার শক্তিশালী ভ্যানটি পাথর কেটে ভিতরে ঢুকে যাবার সময় বাড়তি যে কম্পন সৃষ্টি করবে, সেটা কোথাও ধরা পড়বে না। রিগা ঘড়ি দেখে ঠিক সময়ে ভ্যানের কন্ট্রোল প্যানেলের নির্দিষ্ট সুইচটি স্পর্শ করে, সাথে সাথে সামনের অংশটি খুলে অতিকায় ট্রিলটি বের হয়ে আসে, প্রচণ্ড ঘূর্ণন সৃষ্টি হয়, তারপর সেটি পাথরকে স্পর্শ করে। আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে ছিলটি পাথর কেটে ছোট একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করে ফেলল। ভ্যানটি ধীরে ধীরে পাহাড়ের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যাবার সময় রিগা একবার পিছনে তাকাল, ইনফ্রারেড চশমায় অন্ধকার পৃথিবীটিকে তার কাছে অলৌকিক মনে হয়। এই পৃথিবীটিকে সে হয়তো আর কোনো দিন দেখবে না। পৃথিবীর সাথে তার আর কোনো যোগাযোগ রইল না—কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে রেখে আসা তার ডাইরিটা ছাড়া। সেই ডাইরির খোঁজ কখনো কি কেউ পাবে?