হঠাৎ করে সংশোধনীটি সরিয়ে নেবার পর ব্যাপারটি নিয়ে অনেকেরই কৌতূহল হয়েছিল। সান্ধ্য খবরের বিশেষ ক্লেম কার্ড বের হল, সেটা নিয়ে সবাই হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে জল্পনা-কল্পনা করতে থাকে। তরুণ অনুসন্ধানীরা কম্পিউটার ঘাঁটাঘাঁটি করে নানারকম তন্তু দিতে শুরু করে। কেউ বলল, জিনেটিক পরিবর্তন করে একধরনের অতিমানব তৈরি করা হয়েছিল, যারা পৃথিবী ধ্বংস করতে চাইছিল। কেউ বলল, গ্রহান্তরের আগন্তুক পৃথিবীতে হানা দিয়ে তার নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছিল। আবার কেউ বলল, বায়োকেমেস্ট্রির এক ল্যাবরেটরি থেকে ভয়ংকর এক ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর জীবজগৎকে ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হয়েছিল। সবই অবশ্যি উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা, কারণ এইসব তত্ত্বকে সত্যি বা মিথ্যা কোনোটাই প্রমাণ করার মতো কোনো তথ্য পৃথিবীর ডাটা বেসে নেই, সব একেবারে ঝেড়েপুছে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
বছরখানেক পর সবার কৌতূহল থিতিয়ে এল। শুধুমাত্র জল্পনা-কল্পনা করে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া ১৯শে এপ্রিলের বিপর্যয়সংক্রান্ত তথ্য পৃথিবীর স্বার্থের পরিপন্থী বলে সেটা নিয়ে প্রকাশ্যে গবেষণা করাও সম্ভব নয়, কোনো কম্পিউটারই সাহায্য করতে পারে না। তার ফলে বছর দুয়েকের মাঝেই পৃথিবীর প্রায় সব মানুষই ১৯শে এপ্রিলের বিপর্যয় অজ্ঞাত থেকে যাবে, এই সত্যটি মোটামুটিভাবে মেনে নিল। একজন ছাড়া, সে হচ্ছে রিগা।
রিগা এমনিতে কম্পিউটারের দ্রোন ভাষার উপর কাজ করে। ভাষাটি সহজ নয়, এই ভাষায় প্রোগ্রাম করার যে কয়টি বাড়তি সুবিধে, তাতে পৃথিবীর মানুষের বেশি উৎসাহ নেই। জেই সে পৃথিবীর প্রথম সারির একজন প্রোগ্রামার হয়েও মোটামুটিভাবে সবার কাছে অপরিচিত। দ্রোন ভাষার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি সমস্যাকে কখনো সোজাসুজি সমাধান করার চেষ্টা করে না, কাজেই সবাই হাল ছেড়ে দেবার পরও রিগা কম্পিউটারে ১৯শে এপ্রিল বিপর্যয়ের তথ্য খুঁজে বেড়াতে থাকে। কম্পিউটার তাকে সন্দেহ করে না সত্যি, কিন্তু সে কোনো তথ্য খুঁজে বের করতে পারে না। এইভাবে আরো দুই বছর কেটে যায়।
রিগার বয়স যখন চৌত্রিশ, পারিবারিক ব্যাপারে বিশেষ মন দেয় না বলে তখন তার স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। তাদের একমাত্র ছেলেটিকে নিয়ে তার স্ত্রী একদিন পৃথিবীর অন্য পৃষ্ঠে চলে গেল। হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে ছেলেটিকে প্রায় সত্যিকার মানুষের মতোই জীবন্ত দেখায়, কিন্তু মাঝেমাঝে রিগার খুব ইচ্ছে করত ছেলেটিকে খানিকক্ষণ বুকে চেপে রাখে। কিন্তু ছেলেটি ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে সরে যেতে থাকে। আজকাল হলোগ্রাফিক স্ক্রিলে তার দেখা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এরকম সময়ে রিগা একদিন তার ছেলের সাথে দেখা করতে গেল।
রিগা তার ছেলের কাছে একজন অপরিচিত মানুষের মতো, তাই সঙ্গত কারণেই ছয় বছরের এই শিশুটি তার বাবাকে দেখে খুব বেশি উচ্ছ্বাস দেখাল না। রিগা খানিকক্ষণ কথা বলার চেষ্টা করে খুব সুবিধে করতে পারল না, শিশুদের সাথে কী ভাবে কথা বলতে হয় সে জানে না। ছেলের সাথে ভাব করার আর কোনো উপায় না দেখে রিগা একসময়ে তার পকেট থেকে রেম কার্ডটি বের করে, সেখানে দৈনন্দিন খবর ছাড়াও প্রাগৈতিহাসিক জন্তু-জানোয়ারের উপর একটি দুর্লভ অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানটি শেষ পর্যন্ত এই শিশুটির মন জয় করতে সক্ষম হয়। ঘরের মাঝখানে সত্যিকার জীবন্ত প্রাণীদের মতো হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবিগুলো দেখে বাচ্চাটি হাততালি দিয়ে লাফাতে থাকে। বাচ্চাদের হাসি থেকে সুন্দর কিছু নেই, কিন্তু রিগার যে জিনিসটি প্রথমে চোখে পড়ল, সেটি হচ্ছে তার ফোকলা দাঁত। ছয় বছর বয়সে শিশুদের দুধদাঁত পড়ে নূতন দাঁত ওঠা শুরু করে। বাচ্চাটির দাঁত সবে পড়েছে, এখনো নূতন দাঁত ওঠে নি, তাই প্রতিবার হাসার সময় ফোকলা দাঁত বের হয়ে পড়ছে।
বাচ্চাটির ফোকলা দাঁতটি দেখে হঠাৎ করে রিগা বুঝতে পারে, ১৯শে এপ্রিলের রহস্য কেমন করে সমাধান করতে হবে। রহস্যটি হচ্ছে বাচ্চাটির ফোকলা দাঁতের মতন, সেটি নেই, কারণ তার সম্পর্কে সব তথ্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কেউ যদি সেটাকে খোঁজে কখনো, কিছু পাবে না। কিন্তু ফোকলা দাঁতের অস্তিত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, কারণ প্রত্যেকবার হাসার সময় দেখা যাচ্ছে একটি দাঁত নেই। ১৯শে এপ্রিলের রহস্যও ঠিক সেরকম, সেটি সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই, কিন্তু অন্য সব তথ্যগুলোকে খুঁজে দেখলেই দেখা যাবে সেখানে একটা অসম্পূর্ণতা রয়েছে। সেই অসম্পূর্ণতাই হচ্ছে ১৯শে এপ্রিলের রহস্য। যে কাল্পনিক তথ্য সেই অসম্পূর্ণতাকে দৃঢ় করতে পারবে, সেই তথ্যই হবে এই রহস্যের সমাধান।
রিগা পরবতী চরিশ ঘণ্টা তার ছেলের সাথে সময় কাটালেও মনে মনে সে পরবর্তী কর্মপন্থা ছকে ফেলল। দ্রোন ভাষায় যে নূতন কম্পিউটার প্রোগ্রামটি লিখতে হবে, সেটির কাঠামোও সে মনে মনে ঠিক করে নিল। বহুদিন পর সে বুকের ভিতরে কৈশোরের উত্তেজনা অনুভব করতে থাকে।
কম্পিউটার প্রোগ্রামটি দাঁড় করাতে প্রায় বছরখানেক সময় লেগে গেল, সেটি থেকে ভুলভ্রান্তি সরিয়ে পুরোপুরি কাজের উপযোগী করতে লাগল আরো দুই বছর। তৃতীয় বছরের গোড়ার দিকে রিগা প্রথমবার তার প্রোগ্রামটি পৃথিবীর বড় বড় ডাটা বেসে অনুপ্রবেশ করিয়ে দিল। সুদীর্ঘ সময় ব্যয় করে সেটি জানাল, পৃথিবীর তথ্যভাণ্ডারে যেসব তথ্যের মাঝে বড় ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে, সেগুলো দূর করা যায়, যদি এই কয়টি জিনিস কল্পনা করে নেয়া যায়।