লোকটা গলার স্বর উঁচু করে বলল, তাড়াতাড়ি নাম-ঠিকানা লেখ, কেন এসেছ, কী বৃত্তান্ত—সবকিছু। কোয়ারান্টাইনে নিয়ে তোমাকে পরীক্ষা করতে হবে। এখন কী কী রোগজীবাণু এনেছ সাথে?
রিকি কাঁপাহাতে ফর্মটি পূরণ করতে থাকে। নিজের চোখ-কানকে তার বিশ্বাস হয় না, পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী সে, অথচ তার সাথে এমনভাবে ব্যবহার করছে, যেন সে একজন তৃতীয় শ্রেণীর অপরাধী।
ফর্মটি পূরণ করে রিকি লোকটির হাতে দেয়। লোকটি ভ্রূ কুঁচকে পুরোটা চোখ বুলিয়ে হাতের উল্টো পিঠের ছোট মাইক্রোফোনে কথা বলতে থাকে, অতীত থেকে আরেকজন এসেছে। দাবি করছে সে বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্য ছিল। মনে আছে, একজন দাবি করেছিল সে নাকি যীশুখ্রিস্ট। হাঃ হাঃ হাঃ।
রিকি লোকটার কথা বুঝতে পারে না, কিন্তু ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে তাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করছে। রিকি বুঝতে পারে, প্রচণ্ড ক্রোধের সাথে সাথে আরো একটা অনুভূতি তার ভিতরে ছড়িয়ে পড়ছে, যেটার সাথে তার ভালো পরিচয় নেই–অনুভূতিটি ভয়ের।
দ্বিতীয় লোকটি তার পকেট থেকে চৌকোণা একটা যন্ত্র বের করে ফর্মটি দেখে দেখে রিকির নামটি লিখতে থাকে। রিকি কৌতূহলী হয়ে তাকাল, সম্ভবত একটি কম্পিউটার, কোনো কেন্দ্রীয় ডাটা বেসের সাথে যুক্ত। তার সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে।
লোকটি নিস্পৃহ দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ কিছু-একটা দেখে চমকে উঠল, চোখ বড় বড় করে তাকাল একবার রিকির দিকে। তারপর আবার তাকাল স্ক্রিনের দিকে।
তোমার নামে আমাদের একটা ফাইল আছে। আমার নামে?
হ্যাঁ। ফাইলে একটা খবরের কাগজের কাটিংও আছে। সেখানে তোমার সম্পর্কে বড় খবর। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট করে পালিয়ে গিয়েছিলে, শীকে খুন করেছিলে নিজের হাতে লেখা আছে, তুমি অনেক বড় ক্রিমিনাল!
লোক দুটির গায়ে প্রচণ্ড জোর, খুব সহজে রিকির হাত দুটি পিছনে টেনে হাতকড়া লাগিয়ে দিল। সামনে যাবার ইঙ্গিত করে একজন মাথা নেড়ে বলল, আমি জীবনে অনেক আহাম্মক দেখেছি, কিন্তু প্রেসির মতো আহাম্মক আর দেখি নি।
রিকি মাথা নিচু করে এগিয়ে যায়।
০২. সময়ের অপবলয়
অভ্যাসমতো দরজায় তালা লাগানোর পর হঠাৎ করে রিগার মনে পড়ল আজ আর ঘরে তালা লাগানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। সে যেখানে যাচ্ছে, সেখান থেকে সে সম্ভবত আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। ব্যাপারটি চিন্তা করে একটু আবেগে আপত হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়, কিন্তু রিগার সেই সময়টাও নেই। এখন রাত তিনটা বেজে তেতাল্লিশ মিনিট, আর ঘণ্টা দুয়েকের মাঝেই ভোরের আলো ফুটে উঠবে। সে যেটা কতে যাচ্ছে, তার প্রথম অংশটা ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই শেষ করতে হবে।
ছোট ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে রিগা নিচে নেমে এল। বাকি জিনিসগুলো আগেই বড় ভানটিতে তুলে নেয়া হয়েছে। সে গত পাঁচ বছর থেকে এই দিনটির জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে, খুঁটিনাটি সবকিছু অসংখ্যবার যাচাই করে দেখা হয়ে গেছে, কোথাও কোনো ভুল হবার অবকাশ নেই, তবে ভাগ্য বলে যদি সত্যি কিছু থাকে এবং সে ভাগ্য যদি বেঁকে বসে, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। ছোট ব্যাগটা পাশে রেখে রিগা তার ভ্যানটির সুইচ স্পর্শ করামাত্র সেটি একটি ছোট ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করে। কোন পথে কোথায় যেতে হবে বহুকাল আগে প্রোগ্রাম করে রেখেছে। ভ্যানটি নিঃশব্দে সেদিকে যাত্রা শুরু করে দেয়। নিরীহদর্শন এই ভ্যানটি দেখে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু এটি অসাধ্য সাধন করার ক্ষমতা রাখে।
আবাসিক এলাকার ছোট রাস্তা ধরে খানিকটা এগিয়ে ভ্যানটি হ্রদের তীরের বড় রাস্তায় উঠে পড়ল। রাস্তাটি এরকম সময় নির্জন থাকে। একেবারে মাটি ছুঁয়ে যাওয়া যায়। এ এলাকায় শীতকালে হাড়-কাঁপানো কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস হু-হু করে বইতে থাকে, বসন্তের শুরুতে এতটা খারাপ হবার কথা নয়। রিগা জানালাটা একটু নামিয়ে দেখল, হ্রদের ঠাণ্ডা ভিজে বাতাসের সাথে সাথে সারা শরীর শিউরে ওঠে। রিগা দ্রুত আবার জানালাটা তুলে দেয়। দুহাত একসাথে ঘষে শরীরটা একটু গরম করে সে আকাশের দিকে তাকাল। শুক্লপক্ষের রাত, আকাশে ভাঙা একটা চাঁদ উঠেছে, সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রিগার মনটা হঠাৎ একটু বিষণ্ণ হয়ে যায়। পরিচিত এই পৃথিবীটার জন্যে—যেটা কখনো ভালো করে তাকিয়ে দেখে নি, তার বুকটা হঠাৎ টনটন করতে থাকে।
রিগা জোর করে নিজেকে মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে আনে। একটু পরেই সে যে জিনিসটি করতে শুরু করবে তার খুঁটিনাটি মনে মনে আরো একবার যাচাই করে দেখা দরকার।
ব্যাপারটি শুরু হয়েছিল এভাবে।
সংবিধানে দুশ বছর আগে একটা সংশোধনী যোগ করা হয়েছিল। সংশোধনীটা এরকম : ১৯শে এপ্রিলের বিপর্যয়সংক্রান্ত তথ্যাবলী পৃথিবীর স্বার্থের পরিপন্থী।
সংশোধনীটি বিচিত্র, কিন্তু এই সংশোধনীটির জন্যে যেটা ঘটল, সেটি আরো বিচিত্র। পৃথিবীর তথ্য নিয়ন্ত্রণকারী যাবতীয় কম্পিউটার পৃথিবী থেকে ১৯শে এপ্রিলের বিপর্যয়সংক্রান্ত সকল তথ্য সরিয়ে নিতে শুরু করল। এক শ বছর পর পৃথিবীর ইতিহাসে এই বিপর্যয়ের উপর আর কোনো তথ্য থাকল না। এক শ বছর আগে কোনো-এক এপ্রিল মাসের উনিশ তারিখে পৃথিবীতে কোনো-এক ধরনের বিপর্যয় ঘটেছিল। যেহেতু এ সংক্রান্ত যে-কোনো তথ্য পৃথিবীর স্বার্থের পরিপন্থী, কাজেই সংবিধানের এই সংশোধনীটিও হঠাৎ একদিন সরিয়ে নেয়া হল। ব্যাপারটি ঘটেছিল প্রায় পনের বছর আগে, তখন রিগার বয়স তিরিশ।