রু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন, তাঁর কিছু করার নেই। যাদুঘরের মহাপরিচালকের ভাবাবেগ একটু কমে আসার পর বললেন, আপনার কাছে আমি একটা জিনিস জানতে চাইছিলাম।
বলুন মহামান্য রু।
আপনারা যাদুঘরের পক্ষ থেকে কয়েক বছর পরপর পৃথিবীর ছোটখাটো ব্যবহার্য জিনিস একটা বাক্সে করে মাটির নিচে পুঁতে রাখেন বলে শুনেছি। ভবিষ্যতের মানুষ দেখবে, দেখে আমাদের সময় সম্পর্কে একটা ধারণা করবে, সেজন্যে। ব্যাপারটা সত্যি নাকি?
সত্যি মহামান্য রু। আমরা দশ বছর পরপর এটা করে থাকি। গতবার আপনার লেখা একটা বই আমরা সেখানে রেখেছিলাম।
সেখানে কী কী জিনিস রাখা হয়?
সাম্প্রতিক ছায়াছবি, গানের রেকর্ড, জনপ্রিয় বই, খাবার, খেলনা, পোশাক–এই ধরনের জিনিস।
কোনো খবরের কাগজ কি রাখা হয়?
জ্বি, আমরা খবরের কাগজও রাখি। খবরের কাগজ এবং সাময়িকী।
এবারের কোন খবরের কাগজটি রাখবেন সেটি কি ঠিক করেছেন?
না, এখনো ঠিক করি নি।
আমি যদি বিশেষ একটি খবরের কাগজের কথা বলি–আপনারা কি সেটি রাখবেন?
অবশ্যি অবশ্যি রাখব। আপনি একটি খবরের কাগজ রাখতে চাইবেন, আমরা সেটি রাখব না, সেটি কি কখনো হতে পারে? মহামান্য রু, আপনার জন্যে যে-কোনো কাজ করতে পারলে আমরা আমাদের জীবন ধন্য হয়ে গেছে মনে করি। কোন কাগজটি রাখতে চাইছেন?
সেটি এখনো বের হয় নি, আজ-কালের ভিতরে বের হবে। সেখানে বিজ্ঞান আকাদেমির একজন সদস্য সম্পর্কে কিছু খবর থাকবে। অনেক ব্যক্তিগত খবর। খবরটা ভালো হবে না, দেখে সবাই খুব অবাক হয়ে যাবে। সেই খবরের কাগজটা রাখতে পারবেন?
অবশ্যই অবশ্যই—
যাই হোক, আপনি এখন কাউকে কিছু বলবেন না।
অবশ্যই বলব না, কাউকে বলব না, কিছুতেই বলব না। যাদুঘরের পরিচালক প্রচণ্ড কৌতূহলে ভিতরে ভিতরে হটে গেলেও সেটা বাইরে প্রকাশ করার সাহস পেলেন না।
রু আস্তে আস্তে বললেন, ঠিক আছে, তাহলে, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমার সাথে খানিকক্ষণ সময় ব্যয় করার জন্য।
যাদুঘরের মহাপরিচালক মাথা নিচু করে অভিবাদন করে বিদায় নিয়ে হলোগ্রাফিক স্ক্রিন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
রিকি সবুজ রঙের সুইচটা স্পর্শ করতেই কানে তালা লাগানো শব্দে ইঞ্জিনটা চালু হল। কুরু মহাকাশযানের ইঞ্জিন হাইপারডাইতের জন্যে তৈরি, তার প্রচণ্ড শব্দে পুরো গবেষণাগার থরথর করে কাঁপতে থাকে। রিকি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে ইঞ্জিনটাকে পুরোপুরি চালু হবার সময় দিল। সামনের প্যানেলে সবুজ বাতিটি জ্বলে উঠতেই সে লাল রঙের হ্যান্ডেলটা নিজের দিকে টেনে ধরে। সাথে সাথে সমস্ত শব্দ হঠাৎ যাদুমন্ত্রের মতো থেমে যায়। রিকি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, কিছু ভালো করে দেখা যায় না, কেমন যেন কুয়াশার মতো আবছায়া। সে এখন স্থির সময়ের ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। স্থির সময়ের ক্ষেত্র থেকে অন্য কোনো সময়ে পরিভ্রমণ করার কথা। রিকি দুই হাজার বছর সামনে এগিয়ে যেতে চায়—বর্তমান বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান তার জন্যে যথেষ্ট নয়। দুই হাজারের বেশী আগে যাওয়া সম্ভবত নিরাপদ নয়—মানুষের সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন হয়তো এত বেশি হয়ে যাবে যে রিকি তাল মিলিয়ে থাকতে পারবে না।
রিকি সাবধানে কিছু সংখ্যা কন্ট্রোল বোর্ডে প্রবেশ করাতে থাকে। এই সংখ্যাগুলো তাকে দুই হাজার বছর ভবিষ্যতে নিয়ে যাবে। ভবিষ্যতের মানুষ অতীত থেকে আসা এই অসাধারণ বিজ্ঞানীকে দেখে বিস্ময়ে কেমন হতবাক হয়ে যাবে, চিন্তা করে রিকির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তাকে প্রথম যখন অভিবাদন করবে, উত্তরে বুদ্ধিদীপ্ত একটা কথা বলতে হবে—কী বলা যায়?
কন্ট্রোল প্যানেলে সংখ্যাগুলো দ্রুত পাল্টাতে থাকে। প্রতি মিনিটে রিকি একটি করে শতাব্দী পার হয়ে যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ, তারপর রিকি পৌঁছে যাবে দুই হাজার বছর ভবিষ্যতে। না জানি কত রকম বিস্ময় অপেক্ষা করছে তার জন্যে।
ইঞ্জিনের গর্জন থেমে যাবার পর রিকি সাবধানে চেয়ার থেকে নিজেকে মুক্ত করে দরজা খুলে দিল। দরজার ওপাশে দুজন ফ্যাকাসে চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আছে। লম্বায় তার থেকেও প্রায় অনেকটুকু উঁচু। গায়ে অধস্বচ্ছ এক ধরনের পোশাক, নিশ্চয়ই কোনো আশ্চর্য পলিমারের তৈরি। কোমর থেকে যে জিনিসটা ঝুলছে, সেটাকে দেখে এক ধরনের অস্ত্র বলে মনে হয়।
রিকি হাতের ছোট মাইক্রোফোনে মুখ লাগিয়ে বলল, আমি অতীত থেকে তোমাদের জন্যে শুভেচ্ছা নিয়ে এসেছি।
মাইক্রোফোনটি শক্তিশালী অনুবাদকের সাথে যুক্ত—দুই হাজার বছরে ভাষায় যে পরিবর্তন হয়েছে, সেটা হিসেব করে সঠিক ভাষায় পাল্টে দেয়ার কথা।
লোক দুটি একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। একজন তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে এগিয়ে গিয়ে পরিষ্কার রিকির ভাষায় বলল, শুভেচ্ছা পরে হবে, আগে ফর্মটাতে তোমার নাম–ঠিকানা লেখ–
রিকি উত্তপ্ত হয়ে বলল, তুমি বুঝতে পারছ না—
লোকটা বাধা দিয়ে বলল, খুব বুঝতে পারছি যে তুমি একজন বড় বিজ্ঞানী। যারা অতীত থেকে আসে সবাই দাবি করে তারা বড় বিজ্ঞানী। প্রতিদিন অন্তত দু-চারজন করে আসছে, কাজেই আমাদের এত সময় নেই। ভবিষ্যতে আসা সোজা—কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে অতীতে যাওয়া যায় না। তা হলে ধরে ধরে সবগুলোকে ফেরত পাঠাতাম। তুমি কি ভাব, তোমার এই আজব ভাষায় কথা বলতে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে?
রিকি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, এটা কী ধরনের অভ্যর্থনা।