কিন্তু কেন ঘটতে দেয়া হবে?
কিছু তো করার নেই। এদের বিরুদ্ধে তো কিছু করার নেই।
কেন থাকবে না? অবশ্যি আছে।
আছে? ইলেন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী করার আছে?
আইন করে দেয়া হবে যে এরকম মানুষ আর কখনো জন্মাতে পারবে না।
আইন করে–ইলেন থতমত খেয়ে যায়, মেয়েটা কী বলছে? আইন করে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের জন্ম বন্ধ করে দেয়া হবে?
আমি দুঃখিত, আপনি এতদিন পর পৃথিবীতে ফিরে আসছেন, অথচ এরকম মন-খারাপ করে দেয়া কথা বলছি। আমি দুঃখিত।
দুঃখিত হবার কী আছে। এসব হচ্ছে বেঁচে থাকার মাসুল–
সেটাই তো কথা। কেন দুঃখকষ্ট জীবনের মাসুল হবে? আইন করে কেন জীবন থেকে সব দুঃখকষ্ট সরিয়ে দেয়া হবে না?
ইলেন চুপ করে থাকে। কেন মেয়েটা এরকমু কথা বলছে? জীবন থেকে সব দুঃখকষ্ট আইন করে সরিয়ে দেবে মানে? এর আগেও মধ্যবয়স্ক সেই বিজ্ঞানী একই কথা বলছিল—তখন ভেবেছিল ঠাট্টা করে বলছে। তাহলে কি সত্যি বলেছিল?
হঠাৎ ইলেনের বুকের ভিতর কেমন জানি একটা অশুভ অনুভূতির জন্ম হয়।
মহাকাশযানটি নিরাপদে মহাকাশ কেন্দ্রে অবতরণ করল। ইলেন খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে। এরকম দীর্ঘ অভিযানের পর সাধারণত মহাকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা দরজা খুলে অভ্যর্থনা করে, আজ কেউ এল না। ইলেন নিজেই দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে আতঙ্কে শিউরে ওঠে–
সামনে বিস্তীর্ণ ধূসর প্রাণহীন পৃথিবী। ক্লেদাক্ত আকাশ, দূষিত পূতিগন্ধময় বাতাস আগুনের হলকার মতো বইছে। চারদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় কোথাও কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। বিষাক্ত বাতাসে ইলেনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, চোখ জ্বালা করতে থাকে, কোনোমতে দু হাতে মুখ ঢেকে সে মহাকাশযানের ভিতরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। কোথায় এসেছে সে? কাঁপা গলায় ডাকল, ক্রিকি–
বলুন মহামান্য ইলেন।
বাইরে দেখেছ?
দেখেছি। অত্যন্ত ভয়ংকর পরিবেশ। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ খুব কম, প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড। সাথে নাইট্রাস অক্সাইড এবং সালফার ডাই–অক্সাইড। চারপাশে ভয়ানক তেজস্ক্রিয়তা, সিজিয়াম ১৩৭-এর পরিমাণ দেখে মনে হয় পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটেছে। এখানে সূর্যের আলোতে আলট্রা ভায়োলেট রে-এর পরিমাণ অত্যন্ত বেশি, মনে হয় বায়ুমণ্ডলের ওজোনের স্তর পুরোপুরিভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। মহামান্য ইলেন, এই গ্রহ মানুষের বাসের পক্ষে পুরোপুরি অনুপযুক্ত। এখানে আমি যতদূর দেখেছি কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই।
কী বলছ তুমি!
আমি দুঃখিত মহামান্য ইলেন, কিন্তু আমি সত্যি কথা বলছি।
কিন্তু আমি মাত্র সেদিন পৃথিবীর সাথে কথা বলেছি—
আমি এখনো তাদের সাথে কথা বলছি মহামান্য ইলেন। আপনি বলবেন?
বলব। ভয়ার্ত গলায় ইলেন বলল, বলব।
সাথে সাথে মনিটরে হাসিখুশি একজন মানুষকে দেখা গেল। মানুষটি বলল, আমি কিম রিগার। পৃথিবীর পক্ষ থেকে আপনাকে আমি সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছি সম্মানিত ইলেন।
কিম।
বলুন।
তোমরা কোথায়?
মানে?
আমি কাউকে দেখছি না কেন? পৃথিবী এরকম ভয়ংকর প্রাণহীন কেন? বাতাসে বিষাক্ত গ্যাস–
কিমকে এক মুহূর্তের জন্যে বিভ্রান্ত দেখায়। সামনে সুইচ বোর্ডে দ্রুত কিছু সুইচ স্পর্শ করে নিজেকে সামলে নেয়। মুখে জোর করে একটা হাসি টেনে এনে বলল, আমাদের ছোট একটা ভুল হয়ে গেছে।
ভুল?
হ্যাঁ অনেক দিন করা হয় নি, তাই। ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটা ভুল।
কী ভুল?
আপনার ওমিক্রনিক রূপান্তর করা হয় নি। তা হলে আপনি আমাদের পৃথিবীতে অবতরণ করতে পারতেন। আপনি ভুল পৃথিবীতে অবতরণ করেছেন, সেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে বহুকাল আগে। শিল্পবিপ্লবের অভিশাপে সেই পৃথিবী এখন প্রাণহীন। আপনি সেই ভুল পৃথিবীতে পা দিয়েছেন, বাইরে বের হলে আপনি দশ মিনিটের মাঝে প্রাণ হারাবেন, বিষাক্ত ফসজিল গ্যাসের নূতন একটা আস্তরণ তৈরি হচ্ছে এই মুহূর্তে।
ভূল পৃথিবী?
হ্যাঁ। আমরা এখন নূতন পৃথিবী তৈরি করেছি।
নূতন পৃথিবী?
হ্যাঁ। বিশাল টেটরা কম্পিউটার তৈরি হয়েছে মাটির গহ্বরে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সেটা বড় করা হচ্ছে ধীরে ধীরে। সেই মহা কম্পিউটারে গত শতাব্দীতে সব মানুষের ওমিক্রনিক রূপান্তর করা হয়েছে।
সব মানুষের?
হ্যাঁ, সব মানুষের। বাসের অনুপযুক্ত হয়ে গিয়েছিল পুরানো পৃথিবী। নূতন পৃথিবীতে কোনো বিষাক্ত গ্যাস নেই, ভয়াবহ আলট্রা ভায়োলেট রে নেই, তেজস্ক্রিয় জঞ্জাল নেই। এখানে আছে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, নীল হ্রদ, গহীন অরণ্য, বিশাল অতলান্ত সমুদ্র, মহাসমুদ্র। আগের পৃথিবীতে যেসব ভুল করা হয়েছিল, সব শুধরে নেয়া হয়েছে এখানে। আশ্চর্য একটা শান্তি বিরাজ করছে এই পৃথিবীতে–
তোমরা তা হলে মানুষ নও? তোমরা আসলে কম্পিউটার প্রোগ্রাম? তোমাদের পৃথিবীও কম্পিউটার প্রোগ্রাম?
হ্যাঁ, কিন্তু নিখুঁত প্রোগ্রাম। আমরা নিখুঁত মানুষ। আমাদের এই পৃথিবী নিখুঁত পৃথিবী।
নিঁখুত পৃথিবী?
হ্যাঁ। আপনি আসেন, নিজের চোখে দেখবেন। আশ্চর্য একটা শান্তি এই পৃথিবীতে। যা কিছু খারাপ, যা কিছু অশুভআইন করে সরিয়ে দেবার কথা হচ্ছে এই পৃথিবী থেকে। তখন স্বর্গের মতো হয়ে যাবে এই পৃথিবী।
স্বর্গের মতো?
হ্যাঁ। আপনি আসুন, দেখবেন। আপনাকে অভ্যর্থনা করার জন্যে আমরা প্রস্তুত হয়ে আছি এখানে। ওমিক্রনিক রূপান্তরের জন্যে প্রস্তুত আছেন আপনি?
ইলেন তার কথার উত্তর দিল না, বিড়বিড় করে বলল, পৃথিবী নেই? মানুষ নেই? মানুষের দুঃখ কষ্ট ভালবাসা কিছু নেই? কিছু নেই?