যেটা পড়ল সেটা খুব বিচিত্র।
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রথম শ্রেণীর কম্পিউটারে কিছু প্রোগ্রাম লেখা হয়েছিল, যেটা প্রায় একজন সত্যিকার মানুষের মতো চিন্তা-ভাবনা করতে পারত। ধীরে ধীরে সেটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে এরকম একটা প্রোগ্রামের সাথে যোগাযোগ করে কোনোভাবে বলা সম্ভব হত না সেটি কি মানুষ, না, একটি কম্পিউটার। প্রোগ্রামটি এমনভাবে লেখা হত যেন সেটি একজন নির্দিষ্ট মানুষের মতো চিন্তা করতে পারে। দীর্ঘদিন গবেষণার পর ব্যাপারটি এত নিখুঁত রূপ নিয়ে নিল যে, আক্ষরিক অর্থেই একজন মানুষের মস্তিষ্ককে তার পুরো ক্ষমতাসহ একটি কম্পিউটারের মেমোরিতে বসিয়ে দেয়া যেত। একজন জৈবিক মানুষকে, কম্পিউটারের ভিতরে এই ধরনের যান্ত্রিক রূপ দেয়ার নাম ওমিক্রনিক রূপান্তর।
ওমিক্রনিক রূপান্তর ব্যবহার করে মানুষের মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করার নানা ধরনের ব্যবহারিক গুরুত্ব থাকার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে সেটি একেবারেই কোনো কাজে এল না। কেন এল না তার কারণটি খুব সহজ। ওমিক্রনিক রূপান্তর করে তৈরি করা কম্পিউটার প্রোগ্রামটি এবং সত্যিকার মস্তিষ্কের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। মানুষের প্রকৃত মস্তিষ্ককে কখনো শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হয় না, বাইরের জগৎকে সবসময়েই পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারে। কিন্তু ওমিক্রনিক রূপান্তরে তৈরী মানুষের মস্তিষ্কের অনুলিপির সে-ক্ষমতা নেই। শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কোনো-একটি কম্পিউটারের মেমোরিতে বেঁচে থাকা তাদের কাছে ভয়াবহ অমানুষিক অত্যাচারের মতো, যেন কোনো মানুষকে হঠাৎ করে আলোহীন শব্দহীন এক অতল গহ্বরে ফেলে দেয়া হয়েছে এবং সেখান থেকে তারা বাইরের কোনো কিছুর সাথে কোনোদিন যোগাযোগ করতে পারছে না। সেই অনুভূতি এত ভয়ানক যে ওমিক্রনিক রূপান্তর করে তৈরি করা মস্তিষ্কের প্রতিটি অনুলিপি প্রথম সুযোগ পাওয়ামাত্র নিজেদের ধ্বংস করে ফেলেছিল।
প্রথমে সবাই ভেবেছিল ওমিক্রনিক রূপান্তর করে তৈরি মস্তিষ্কের অনুলিপিগুলোকে দেখার, শোনার এবং কথা বলার সুযোগ করে দেয়া হলেই হয়তো এই সমস্যার সমাধান হবে। দেখা গেল সেটা সত্যি নয়। এই ধরনের মস্তিষ্কের অনুলিপি সবসময়েই অনুভব করেছে তারা পুরো জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, তাদের দেহ নেই বলে তাদের অস্তিত্ব নেই। কৃত্রিম উপায়ে তারা যা দেখে বা যা শোনে, তার সাথে বাস্তব জগতের কোনো মিল নেই। সে কারণে সবসময়েই তারা ভয়াবহ বিষণ্ণতায় ডুবে রয়েছে।
ওমিক্রনিক রূপান্তর করে তৈরি মস্তিষ্কের অনুলিপিগুলোকে বিষণ্ণতা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল বিচিত্রভাবে, অনেকগুলো মস্তিষ্কের অনুলিপিকে এক কম্পিউটারে নিজেদের মাঝে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেয়ার পর। দেখা গেল হঠাৎ করে কম্পিউটারের ভিতর একটা ছোট সমাজ গড়ে উঠেছে। মস্তিষ্কের অনুলিপিগুলোর মাঝে প্রথমে পরিচয় হল, তারপর বন্ধুত্ব হল এবং সবশেষে একে অন্যকে অসহনীয় বিষণ্ণতা থেকে টেনে তুলতে শুরু করল।
তখন হঠাৎ করে ওমিক্রনিক রূপান্তরের সবচেয়ে বড় সাফল্যটি আবিষ্কৃত হল। কম্পিউটারের মাঝে বেঁচে থাকা মস্তিষ্কের অনুলিপিদের বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই, তাদের জন্যে প্রয়োজন কম্পিউটারের ভিতরে একটা জগৎ। পৃথিবীর কম্পিউটার প্রোগ্রামাররা তখন কম্পিউটারের মাঝে একটা জগৎ তৈরি করার কাজে লেগে গেলেন। বিচিত্র সব প্রোগ্রাম লেখা হল। মস্তিষ্কের অনুলিপিগুলোর জন্যে তৈরি হল দেহ, কম্পিউটার প্রোগ্রামে। পুরুষের জন্যে পুরুষের দেহ, নারীর জন্য নারীর। সেইসব দেহ কম্পিউটারের ভিতরে এক কাল্পনিক জগতে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, গাছপালা তৈরি হল কম্পিউটার প্রোগ্রামে। আকাশ তৈরি হল, বাতাস তৈরি হল, দিন, রাত, ঋতু তৈরি হল। সত্যিকার মানুষের মস্তিষ্কের নিখুঁত অনুলিপি একটা শরীর নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকল। সেই জগতে তারা ভুলে গেল তাদের দেহ, তাদের চারপাশের জগৎ কোনো-এক প্রোগ্রামের সৃষ্টি। তাদের মনে হল তারা সত্যিকারের মানুষ, তাদের চারপাশের জগৎ সত্যিকারের জগৎ। সেইসব মানুষের মাঝে দুঃখ-বেদনা হাসি-কান্না খেলা করতে থাকে। তারা ধরাছোঁয়ার বাইরের সেই জগতে নিজেদের জন্যে নূতন একটা জগৎ তৈরি করে নেয়। সত্যিকার জগতের সাথে তার আর কোনো পার্থক্য নেই।
ইলেন রূদ্ধশ্বাসে ওমিক্রনিক রূপান্তর নামের সেই বিচিত্র গবেষণার কথা পড়তে থাকে। পৃথিবীর দিকে ছুটে যাওয়া এই মহাকাশযানের নিঃসঙ্গ যাত্রীটি সময়ের কথা ভুলে যায়।
পৃথিবীর খুব কাছাকাছি এসে ইলেন আবার পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকক্ষের সাথে যোগাযোগ করল। এবারে তার কথা হল একজন কমবয়সী মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটি কোনো কারণে খুব বিচলিত।
বলল, আপনি খুব ভালো আছেন, মহাকাশে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেন খামোকা পৃথিবীতে ফিরে আসছেন?
কেন? কী হয়েছে?
আজকের সন্ধের খবর। লেজারকমে চাকরি করে একজন মানুষ, কাজকর্ম করে না বলে চাকরি গেছে। সেই মানুষ ক্ষেপে গিয়ে এগারটা মানুষ খুন করে ফেলল। চিন্তা করতে পারেন?
ইলেন জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করে বলল, কী দুঃখের ব্যাপার।
হ্যাঁ। এদের সহ্য করা হয় বলেই তো এই অবস্থা।
সহ্য করা না-করা তো প্রশ্ন নয়। এরকম একজন দুজন মানুষ তো সবসময়েই থাকবে। এদের মনে হয় পুরো মানসিক ভারসাম্য নেই। হঠাৎ হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এরকম এক-আধটা অঘটন ঘটায়।