চেষ্টা করছি মহামান্য ইলেন।
সপ্তাহ দুয়েক পর ক্রিকি পৃথিবীর একজন সত্যিকার মানুষের সাথে ইলেনের যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারল। আন্তঃগ্রহ যোগাযোগ বিভাগের একজন বিজ্ঞানী। মধ্যবয়সী একজন হাসিখুশি মানুষ। ইলেন প্রাথমিক সম্ভাষণ বিনিময় শেষ করে বলল, পৃথিবীতে এখন কোন ঋতু চলছে?
বসন্ত। ভারি বাজে সময়।
কেন, বাজে সময় হবে কেন? বসন্ত ফুল ফোঁটার সময়।
সেটাই তো বাজে। ফুলের পরাগরেণুতে বাতাস ভারি হয়ে আছে। দেশসুদ্ধ মানুষের অ্যালার্জি। হাঁচি দিতে দিতে একেকজনের কী অবস্থা।
ইলেন শব্দ করে হাসে, কী বলছেন আপনি! মহাকাশযানের একেবারে পরিশুদ্ধ বাতাসে আমি ছয় বছর থেকে আছি। এই ছয় বছরে একটিবারও হাঁচি দিই নি। আমি তো ফুলের পরাগ শুকে কিছু হাঁচি দিতে আপত্তি করব না।
বিজ্ঞানী ভদ্রলোক বিরস মুখে বললেন, দূর থেকে ওরকমই মনে হয়। অ্যালার্জি জিনিসটা খুব খারাপ। সবাই বলছি, আইন করে ফুলের পরাগ বন্ধ করে দেয়া হোক।
ইলেন হো হো করে হেসে উঠে, ভালোই বলেছেন, আইন করে ফুলের পরাগ বন্ধ করে দেয়া হবে। কয়দিন পরে শুনব যা কিছু খারাপ, আইন করে বন্ধ করে দেয়া হবে। রোগ শোক দুঃখ কষ্ট জিরা ব্যাধি, পাপ গ্লানি সব বেআইনি–
বিজ্ঞানী ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন, কেন, আপনি এত হাসছেন কেন? আমি তো কিছু দোষ দেখি না আইন করে কিছু খারাপ জিনিস বন্ধ করে দেয়ায়। কলকারখানা বাতাসে কী পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস ছড়াত মনে আছে? আইন করে সেসব বন্ধ করে দেয়া হল না? এখন বাতাস কত পরিষ্কার। মাঠে ঘাস জন্মেছে, আকাশে পাখি উড়ছে, নদীতে মাছ।
ইলেন উজ্জ্বল চোখে বলল, সত্যি? আমি যখন পৃথিবী ছেড়েছি, কী ভয়াবহ অবস্থা পৃথিবীতে। নিঃশাস নেয়ার অবস্থা ছিল না।
সব পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। এলে চিনতে পারবেন না। কলকারখানার জঞ্জাল, তেজস্ক্রিয় বিষাক্ত গ্যাস, কিছু নেই। ঝকঝকে একটা পৃথিবী। সত্যি কথা বলতে কি একটু বেশি ঝকঝকে। গাছপালা ফুল ফল একটু কম হলেই মনে হয় ভালো ছিল।
ইলেন বিজ্ঞানী ভদ্রলোকের সাথে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে খানিকক্ষণ কথা বলে জিজ্ঞেস করে, গত এক শ বছরে বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি কি বলতে পারেন?
গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার? বিজ্ঞানী ভদ্রলোককে একটু বিভ্রান্ত মনে হল। মাথা চুলকে বললেন, গত এক শ বছরে সত্যি কথা বলতে কি সেরকম বড় কোনো আবিষ্কার হয় নি। অন্তত আমার তো মনে পড়ে না। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে কিছু নূতন জন্তু জানোয়ার তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেটা তো বড় আবিষ্কার হল না, কি বলেন?
পদার্থবিজ্ঞানে? রসায়ন? ইঞ্জিনিয়ারিং?
পদার্থবিজ্ঞানে ব্ল্যাক হোল নিয়ে বড় একটা আবিষ্কার হয়েছে, ল্যাবরেটরিতে ব্ল্যাক হোেল তৈরি করা জাতীয় ব্যাপার। আমি ঠিক বুঝি না সেসব। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অনেক কিছু হয়েছে, কোনটা বলি আপনাকে? কম্পিউটারের নূতন মডেলগুলো অসাধারণ, আপনার মহাকাশযানের কম্পিউটার এখন হাতের রিস্টওয়াচে এঁটে যায়।
এরকম কোনো আবিষ্কার নেই, যেটা অন্য দশটা আবিষ্কার থেকে আলাদা করে বলা যায়?
নিশ্চয়ই আছে, এক সেকেন্ড অপেক্ষা করেন, আমি ডাটা বেস থেকে বের করে আনি। বিজ্ঞানী ভদ্রলোক খানিকক্ষণ কী-একটা দেখে মাথা চুলকে বললেন, ভারি আশ্চর্য ব্যাপার।
কী হয়েছে?
এখানে লেখা রয়েছে, গত শতাব্দীর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার ওমিক্রনিক রূপান্তর। এই আবিষ্কার নাকি পৃথিবী এবং মানুষ জাতিকে নূতন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে।
সেটা কী?
বিজ্ঞানী ভদ্রলোক অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে একটু হেসে বললেন, মজার ব্যাপার শুনবেন? আমি কখনো এর নাম পর্যন্ত শুনি নি। এই প্রথম শুনলাম, ওমিক্রনিক রূপান্তর। কী আশ্চর্য একটা নাম। যে-আবিষ্কার মানবজাতির জন্যে নূতন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, সেটার নাম পর্যন্ত আমি শুনি নি—কী লজ্জার ব্যাপার বলেন দেখি।
লজ্জার কী আছে? আবিষ্কারটি নিশ্চয়ই আপনার বিষয়ে নয়–
নিশ্চয়ই নয়। নিশ্চয়ই জীববিজ্ঞান বা ডাক্তারি শাস্ত্রের কিছু হবে। আপনি অপেক্ষা করল, আমি বের করে আনি ব্যাপারটা কি, এই ডাটা বেসেই আছে।
ইলেন বলল, আপনাকে বের করতে হবে না, আমি পরে বের করে নেব। আমার সময় পার হয়ে গেছে, যোগাযোগ কেটে দিচ্ছে এক্ষুণি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনার পৃথিবীতে ফিরে আসা অনেক আনন্দের হোক।
সত্যিকার একজন মানুষের সাথে কথা বলে ইলেনের বেশ লাগল। বড় কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ হলে প্রয়োজনীয় সব তথ্য নিঁখুতভাবে পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে অপ্রয়োজনীয় তুচ্ছ একটা খবরের জন্যে মনটা বুভুক্ষু হয়ে থাকে। সেরকম একটা খবর দিতে পারে শুধু মানুষ। যেমন পৃথিবীতে এখন বসন্তকাল, অসংখ্য ফুল ফুটেছে, ফুলের পরাগরেণু বাতাসে ভাসছে এবং সেই রেণু মানুষের অ্যালার্জির শুরু করেছে। এই নেহায়েত অপ্রয়োজনীয় এবং প্রায় অর্থহীন তথ্যটি ইলেনকে হঠাৎ করে একেবারে মাটির পৃথিবীর কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। বড় ভালো লেগেছে শুনে যে বড় বড় কলকারখানার আবর্জনা এবং জঞ্জাল পৃথিবীকে পুরোপুরি কলুষিত করে ফেলবে সেরকম যে-ভয়টা ছিল সেটা এড়ানো গেছে। পৃথিবী আবার বাসযোগ্য হয়েছে, ফুলে ফলে ভরে উঠেছে শুনে ইলেনের হঠাৎ করে আবার মানবজাতির উপর বিশ্বাস ফিরে এসেছে।
প্রাত্যহিক কাজকর্ম শেষ করে ইলেন মহাকাশযানের কম্পিউটার ক্রিকিকে বলল, পৃথিবীর কেন্দ্রীয় তথ্যকেন্দ্র থেকে ওমিক্রনিক রূপান্তরসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য বের করে আনতে। ক্রিকি প্রায় বার টেরাবাইট তথ্য বের করে আনল। ইলেন তখন বলল, তার মাঝখান থেকে মূল জিনিসগুলো বের করে আনতে। ক্রিকি সেগুলি বের করে আনার পর ইলেন পড়তে বসে।