শুভ জাগরণ? ইলেন এই অভিনব সম্ভাষণ শুনে একটু হকচকিয়ে গেল। কে জানে, কেউ যদি চার বছর পর ঘুম থেকে জেগে ওঠে তাকে সত্যিই হয়তো এভাবে সম্ভাষণ জানানো যায়।
মহামান্য ইলেন, আপনি কী রকম অনুভব করছেন?
ভালো।
চমৎকার। আপনি নিজে থেকে শরীরের কোনো অংশ নাড়াবেন না। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে আপনি শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সাময়িকভাবে দুর্বল অনুভব করতে পারেন। আমি আগে একটু পরীক্ষা করে নিতে চাই।
বেশ।
গত চার বছর আমি আপনার শরীরের যত্ন নিয়েছি, কাজেই কোনো ধরনের সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আমি পরীক্ষা করে নিশ্চিত না হচ্ছি, আপনি শুয়ে থাকেন।
বেশ।
শরীরের নানা অংশে লাগানো নানা প্রোব দিয়ে ক্রিকি নানা ধরনের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ পাঠাতে থাকে। ইলেন ধৈর্য ধরে শুয়ে রইল, দুই পায়ে প্রথমে ঝিঝি ধরার মতো একটা অনুভূতি হয়, দুই হাতে খানিকটা মৃদু কম্পন, কানের মাঝে একবার খানিকটা ভোঁতা শব্দ হল, তারপর একসময় সবকিছু থেমে গেল। ক্রিকির কণ্ঠস্বর আবার শুনতে পেল। ইলেন, চমৎকার মহামান্য ইলেন। সবকিছু ঠিক আছে।
শুনে খুশি হলাম। এখন কি উঠতে পারি?
পারেন। তবে হঠাৎ করে উঠবেন না। খুব ধীরে ধীরে। প্রথমে বাম হাত উপরে তুলুন। তারপর ডান হাত—
ইলেন ঘণ্টাখানেক পর মহাকাশযানের বিশেষ টিলেঢালা একটা কাপড় পরে জানালার কাছে এসে বসে। সুদীর্ঘ অভিযান শেষ করে এই মহাকাশযানটি এখন পৃথিবীর দিকে ফিরে যাচ্ছে, ইলেনকে ঘুম থেকে তোলা হয়েছে সেজন্যে। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকারে অসংখ্য নক্ষত্র স্থির হয়ে জ্বলছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে কেমন জানি মন-খারাপ হয়ে যায়। একটা বলকারক পানীয় খেতে খেতে ইলেন মহাকাশযানের লগ পরীক্ষা করছিল। গত চার বছরে কী কী ঘটেছে সব এই লগে তুলে রাখা হয়েছে। বেশির ভাগই বৈজ্ঞানিক তথ্য, একনজর দেখে চট করে বোঝার মতো কিছু নয়। পৃথিবীতে পৌছে সেখানকার বড় কম্পিউটারে দীর্ঘ সময় এগুলো খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হবে। তিন বছরের মাথায় একটা বড় গোছের গ্রহ-কণিকার সাথে প্রায় সামনা-সামনি ধাক্কা লেগে যাবার আশঙ্কা হয়েছিল, সেটি ছাড়া পুরো সময়টাকে বলা যেতে পারে বৈচিত্র্যহীন। মহাকাশ অভিযানের প্রথম দুই বছর ইলেন শীতল-কক্ষের বাইরে ছিল। সেই সময়টুকুর স্মৃতি তার কাছে খুব সুখকর নয়। দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতির পরেও মহাকাশযানের একাকীত্ব তার কাছে একেবারে অসহনীয় মনে হয়েছিল। এত দীর্ঘ যাত্রায় সাধারণতঃ সঙ্গী দেয়া হয় না, অতীতে দেখা গিয়েছে সেটি জটিলতা আরো বাড়িয়ে দেয়।
ইলেন মনিটরটি বন্ধ করে মহাকাশযানের কম্পিউটার ক্রিকিকে ডাকল, ক্রিকি।
বলুন মহামান্য ইলেন।
পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ হয়েছে?
এইমাত্র হল। আমি নিশ্চিত হবার জন্যে আরেক বার খবর পাঠিয়েছি।
চমৎকার। পৃথিবীটা তাহলে এখনো বেঁচে রয়েছে।
ইলেন কথাটি ঠিক ঠাট্টা করে বলে নি। পৃথিবীর অস্তিত্ব নিয়ে একটা আশঙ্কা সব সময় তার বুকে দানা বেঁধে আছে। সে এই মহাকাশযানে করে যখন পৃথিবী ছেড়ে এসেছিল, তখন পৃথিবীর অবস্থা ছিল খুব করুণ। শিল্প বিপ্লবের পর সারা পৃথিবীতে অসংখ্য কলকারখানা গড়ে উঠেছিল, তাদের পরিত্যক্ত রাসায়নিক জঞ্জালে সারা পৃথিবী এত কলুষিত হয়েছিল যে, মানুষের পক্ষে সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকা একরকম অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং পারমাণবিক শক্তিচালিত অসংখ্য কলকারখানা থেকে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা পৃথিবীর বাতাসে স্থান লাভ করেছে তার পরিমাণ ভয়াবহ। কাজেই পৃথিবী এখনো বেঁচে আছে এবং মহাকাশযানের সাথে যোগাযোগ হয়েছে, সেটা নিঃসন্দেহে ইলেনের একটা বড় স্বস্তির কারণ। সে ক্রিকিকে বলল, যোগাযোগটা আরেকটু ভালো করে থোক, তখন চেষ্টা কর একজন মানুষের সাথে কথা বলতে। যদি মানুষ পাওয়া যায়, আমাকে কথা বলতে দিও।
ঠিক আছে মহামান্য ইলেন।
খুব ইচ্ছে করছে একজন সত্যিকার মানুষের সাথে কথা বলতে।
বিচিত্র কিছু নয়, আপনি প্রায় ছয় বৎসর কোনো মানুষের সাথে কথা বলেন নি।
হ্যাঁ, তার মাঝে অবশ্যি চার বৎসর ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছি।
মহাজাগতিক রশি ব্যবহার করে মহাকাশযানটির গতিবেগ অবশ্যি অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কাজেই পৃথিবীতে এর মাঝে অনেক দিন পার হয়ে গেছে।
সেটা সত্যি। আমি যাদের পৃথিবীতে ছেড়ে এসেছি, তাদের কেউ বেঁচে নেই।
যারা শীতল-ঘরে আছে, তারা ছাড়া।
শীতল-ঘরে আর কয়জনই-বা যায়। ইলেন খানিকক্ষণ মনে মনে হিসেব করে বলল, পৃথিবীতে এর মাঝে এক শ দশ বছর পার হয়ে গেছে। তাই না?
একশ দশ বছর চার মাস তের দিন। আরো যদি নিঁখুত হিসেব চান, তা হলে তের দিন চার ঘণ্টা উনিশ মিনিট একুশ সেকেণ্ড।
দীর্ঘ সময়। কি বল?
হ্যাঁ মহামান্য ইলেন। দীর্ঘ সময়।
ইলেন খানিকক্ষণ আনমনা হয়ে বসে থাকে। একটু পর আস্তে আস্তে বলে, বুঝলে ক্রিকি, আমার স্ত্রী যখন অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল, মনে হল বেঁচে থেকে কী হবে। এই অভিযানটিতে তখন নিজে থেকে নাম লিখিয়েছিলাম। নাহয় কি কেউ এরকম একটা অভিযানে যায়? পৃথিবীতে এক শতাব্দীর বেশি সময় পর ফিরে যাওয়া অনেকটা নূতন একটা জীবনে ফিরে যাওয়ার মতো। এতদিনে পৃথিবীর নিশ্চয়ই অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কী বল?
নিশ্চয়ই।
খুব কৌতূহল হচ্ছে দেখার জন্যে।
খুবই স্বাভাবিক।
ইলেন তার প্রাত্যহিক কাজে ফিরে যাবার আগে বলল, চেষ্টা করতে থাক একজন সত্যিকার রক্তমাংসের মানুষ খুঁজে বের করতে। খুব ইচ্ছে করছে একজন মানুষের সাথে কথা বলতে।