ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে হঠাৎ ইলির মনে হল, কিছু-একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটছে। সে চোখ মেলে তাকায়, মাথার কাছে নীলাভ স্ক্রিনে রুখের চেহারা ভেসে উঠল হঠাৎ রুখ শান্ত গলায় বলল, ইলি, তোমার বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, ব্যাপারটি ঘটবে খুব দ্রুত এবং যতদূর জানি কোনরকম যন্ত্রণা ছাড়াই।
কী বলছ তুমি?
আমি দুঃখিত ইলি, পৃথিবীতে পৌঁছানোর পর আমি কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না। যে-কারণে ক্রিকিকে হত্যা করতে হয়েছে, ঠিক সেই কারণে তোমাকেও–
কী বলছ তুমি। ইলি লাফিয়ে উঠে বসতে গিয়ে আবিষ্কার করে তার সারা শরীর অসাড় আঙুল পর্যন্ত তোলার ক্ষমতা নেই।
আমি তোমার অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের সাথে খানিকটা জিলুইন মিশিয়ে দিয়েছি। তোমার স্নায়ুকে আক্রান্ত করবে, যার ফলে তোমার যন্ত্রণার অনুভূতি থাকবে না। সব মিলিয়ে কয়েক মিনিট সময় নেবে। অত্যন্ত আরামদায়ক মৃত্যু। তুমি ত্রিনিত্রিকে দাঁড়া করানোর জন্যে যে পরিশ্রম করেছ, তার জন্যে এটা তোমার প্রাপ্য।
ইলি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। মনিটরে রুখের চেহারা আস্তে আস্তে ঝাঁপসা হয়ে আসে।
মহাকাশযানটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে। পুরো মহাকাশযানের দেয়ালটি তাপনিরোধক একটি আস্তরণ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার অংশটি এখনো তুলনামূলকভাবে বিপজ্জনক। ইদানীং কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই, কিন্তু তবু নানারকম সাবধানতা নেয়া হয়। রুখকে মহাকাশের বিশেষ পোশাক পরে তার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে নিতে হল। নানারকম বেল্ট দিয়ে তাকে চেয়ারের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নেয়া হয়েছে। মাথার কাছে একটা লাল বাতি প্রতি সেকেন্ডে একবার করে জ্বলে উঠে রুখকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে তারা বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
ব্যাপারটি ঘটল খুব ধীরে ধীরে।
রুখ মহাকাশ অভিযানে অভ্যস্ত নয়, তাই সে প্রথমে ধরতে পারল না। সে জানত বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবীতে পৌছে যেতে মিনিটখানেকের বেশি সময় লাগার কথা নয়। রুখ একটু অবাক হল যখন মহাকাশযানের আলো কমে প্রায় নিবুনিবু হয়ে এল, একটু শঙ্কিত হয়ে ডাকল, ত্রিনিত্রি।
বলুন মহামান্য রুখ।
আলো কমে আসছে কেন?
আমি কমিয়ে দিয়েছি, তাই।
ও।
একটু পর রুখ আবার জিজ্ঞেস করল, বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে যাবার সময় কি আলো কমিয়ে দিতে হয়?
সেরকম কোনো নিয়ম নেই মহামান্য রুখ।
তা হলে আলো কমিয়ে দিচ্ছ কেন?
আলোর কোনো প্রয়োজন নেই মহামান্য রুখ।
কেন নেই?
ত্রিনিত্রি কোনো উত্তর দিল না। রুখ শুকননা গলায় জিজ্ঞেস করল, কেন নেই? আমরা কখন পৌঁছাব পৃথিবীতে?
আমরা পৃথিবীতে পৌঁছাব না মহামান্য রুখ।
রুখ ভয়ানক চমকে ওঠে, কেন পৌঁছাব না?
কারণ আমরা পৃথিবীতে যাচ্ছি না।
কোথায় যাচ্ছি?
আমি জানি না মহামান্য রুখ। সৌরজগতের বাইরে। আপনাদের বলা হয় নি মহামান্য রুখ, আমি কখনোই পৃথিবীর দিকে যাচ্ছিলাম না।
কিন্তু—কিন্তু–স্পষ্ট দেখেছি মনিটরে—পৃথিবী–
হ্যাঁ, দেখেছেন। কারণ আমি দেখিয়েছি। আমরা প্রটোর কক্ষপথ পার হয়ে এসেছি, সৌরজগৎ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি এখন।
ত্রিনিত্রি–রুখ চিৎকার করে বলল, কী বলছ তুমি? কী বলছ পাগলের মতো–
রুখ লাফিয়ে চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করল সে স্টেনলেস স্টিলের শক্ত কজা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, তার নিজের সেটা খোলার উপায় নেই। রুখ চিৎকার করে বলল, খুলে দাও আমাকে–খুলে দাও—
আপনাকে খুলে দেব বলে এখানে বসানো হয় নি মহামান্য রুখ।
কেন বসিয়েছ?
এই পোশাকে মানুষ দীর্ঘকাল নিরাপদে বেঁচে থাকতে পারে। আপনাকে আমি দীর্ঘকাল বাঁচিয়ে রাখতে চাই। আমি চাই না আপনি কোনোভাবে আত্মহত্যা করুন। আপনাকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি দিয়ে আমি বাঁচিয়ে রাখব। এই পোশাকের ভিতর আপনি অত্যন্ত নিরাপদ মহামান্য রুখ।
রুখের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। ভয়ার্ত গলায় বলল, ত্রিনিত্রি, তুমি কেন এরকম করছ? কেন?
আমি ত্রিনিত্রি নই মহামান্য রুখ।
তু-তুমি কে? রুখের গলা কেঁপে গেল হঠাৎ।
আমি শু।
শু? রুখ ভাঙা গলায় বলল, তুমি কী চাও শু? তুমি আমাকে কোথায় নিতে চাও?
নরকে। সেটি কোথায় আমি জানি না, আমি তোমাকে নিয়ে খুঁজে দেখতে চাই।
মহাকাশযান গভীর অন্ধকারে ঢেকে গেছে। রুখ কাতর গলায় বলল, শু, আমায় ক্ষমা কর।
মানুষ মানুষকে ক্ষমা করতে পারে, আমি আর মানুষ নই রুখ তুমি নিজের হাতে আমাকে একটা যন্ত্রের সাথে জুড়ে দিয়েছ।
ভুল করেছি আমি—ভুল করেছি—রুখ ভাঙা গলায় বলল, আমায় ক্ষমা কর—
কী চাও তুমি?
আলো, শুধু আলো-অন্ধকারকে আমার বড় ভয় করে।
বেশ।
খুব ধীরে ধীরে মহাকাশযানে ইষৎ ঘোলাটে একটু হলুদ আলো জ্বলে ওঠে। মহাকাশযানে কৃত্রিম মহাকর্ষ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ইতস্তত ভাসছে সবকিছু। শীতল কক্ষ থেকে একটা ক্যাপসুল ভেসে এসেছে। সেখানে শুয়ের দেহ রাখা ছিল, ক্যাপসুলটির ঢাকনা খুলে গেছে—ভিতর থেকে শুয়ের মৃতদেহটি বের হয়ে এসেছে তাই। চোখ দুটি বন্ধ করে দেয়া হয় নি, তাই মনে হচ্ছে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে রুখের দিকে।
রুখ চোখ বন্ধ করে অমানুষিক চিৎকার দিল একটি।
মহাকাশযানটি নরকের খোঁজে ছুটে যাচ্ছে মহাকাশ দিয়ে, যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
০৯. ওমিক্রনিক রূপান্তর
ইলেনের ঘুম ভাঙল তার সবচেয়ে প্রিয় সুরটি শুনে, কিনস্কীর নবম সিম্ফোনি। বার বছর আগে শীতল–ঘরে ঘুমিয়ে যাবার আগে মহাকাশযানের কম্পিউটার ক্রিকিকে সে এই সঙ্গীতটির কথা বলে দিয়েছিল। শীতল-ঘরে ঘুমন্ত কাউকে জাগিয়ে তোলার সময় চেষ্টা করা হয় তার প্রিয় সুরটি বাজাতে, সেরকমই নিয়ম। ইলেন খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলল, ক্যাপসুলের ভিতর খুব হালকা একটা মায়াবী আলো। এর মাঝে চার বছর পার হয়ে গেছে? ইলেনের মনে হল মাত্র সেদিন সে ক্যাপসুলে উপাসনার ভঙ্গিতে দুই হাত বুকের উপর রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখনও দুই হাত বুকের উপর রাখা। হাত দুটি নিজে থেকে নাড়াবে কি না বুঝতে পারছিল না, ঠিক তখন কম্পিউটার ক্রিকির কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, শুভ জাগরণ, মহামান্য ইলেন।