তুমি কি জান তোমাকে কী ভাবে পুনর্জীবিত করা হয়েছে?
ত্রিনিত্রি এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, না মহামান্য ইলি। আমি একটি সফটওয়ার, কোন হার্ডওয়ারে আমাকে ব্যবহার করা হচ্ছে আমার জানার কোনো উপায় নেই মহামান্য ইলি। ওই
তুমি কি জানতে চাও ত্রিনিত্রি?
ত্রিনিত্রি কোনো উত্তর দিল না
ত্রিনিত্রি? তুমি কি জানতে চাও?
না। আমি জানতে চাই না। আমার জানার কোনো প্রয়োজনও নেই মহামান্য ইলি।
বেশ। ইলি কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, আমরা কয়েক সপ্তাহ থেকে শুন্যে ঝুলে আছি। তুমি কি কক্ষপথ ঠিক করে পৃথিবীর দিকে রওনা হতে পারবে?
নিশ্চয়ই পারব মহামান্য ইলি। এক মুহূর্ত পরে বলল, নূতন যে-প্রসেসটির ব্যবহার করছেন, তার ক্ষমতা অসাধারণ মহামান্য ইলি। কক্ষপথের বিচ্যুতি হিসেব করতে আমার মাত্র তেরো পিকো সেকেন্ড সময় লেগেছে।
চমৎকার! তুমি কাজ শুরু কর তাহলে।
মহাকাশযানটি যখন বৃহস্পতির কক্ষপথ অতিক্রম করে যাচ্ছিল, রুখের অনুরোধে ইলি ত্রিনিত্রির বহির্জাগতিক সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল, রুখ সবার সাথে নিরিবিলি কিছু কথা বলতে চায়।
ইলি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, রুখ, তুমি এখন নির্ভয়ে কথা বলতে পার, ত্রিনিত্রি আমাদের কথা শুনতে পারবে না।
তুমি নিশ্চিত?
হ্যাঁ।
আমি শুয়ের ব্যাপারটির একটি পাকাপাকি নিষ্পত্তি করার কথা ভাবছিলাম।
তুমি কী রকম নিষ্পত্তি কথা বলছ?
ত্রিনিত্রির সিপিইউ-তে শুয়ের মস্তিষ্ক ব্যবহার করার ব্যাপারটি পৃথিবীতে ভালো চোখে দেখা হবে না।
ইলি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, দেখার কথা নয়।
আমার মনে হয় ব্যাপারটি গ্রহণযোগ্য করার একটিমাত্র উপায়।
সেটি কি?
আমাদের প্রমাণ করতে হবে আমরা শুয়ের মস্তিষ্ক নিয়েছি তার মৃত্যুর পর। এবং তার মৃত্যু হয়েছিল দুর্ঘটনায়, সেখানে আমাদের কোনো হাত ছিল না।
ইলি হাসার ভঙ্গি করে বলল, সেটি যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য একটি ঘটনা। ত্রিনিত্রি ধ্বংস হবার পর আমাদের কোনো-একজনের মৃত্যু ঘটা এমন কোনো বিচিত্র ঘটনা নয়। আমরা খুব সহজেই প্রমাণ করতে পারব যে, ত্রিনিত্রি বিধ্বস্ত হবার সময় শু শীতল-ঘরে ছিল, তার অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাবার কারণে মৃত্যু ঘটেছে, আমরা যেতে যেতে সে মারা গিয়েছে।
রুখ চিন্তিত মুখে বলল, সেটা কি সত্যি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যাবে?
না পারার তো কোনো কারণ নেই।
রুক ধীরে ধীরে ক্রিকির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রিকি, তুমি এতক্ষণ একটি কথাও বল নি। কিছু কি বলতে চাও?
না–মানে আমার কিছু বলার নেই।
শু দুর্ঘটনায় মারা গেছে, এই সত্যটি মেনে নিতে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে?
ক্রিকি দুর্বলভাবে মাথা নাড়ে না, কোনো আপত্তি নেই।
শুয়ের মৃত্যুর ব্যাপারটি কি তোমাকে খুব বিচলিত করেছে?
না, মানে—আমি আগে কখনো কাউকে মারা যেতে দেখি নি, তাই—
তোমার ভিতরে কি কোনো অপরাধবোধের জন্ম হয়েছে?
ক্রিকি মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে।
রুখ ইলির দিকে তাকিয়ে বলল, শু দুর্ঘটনায় মারা গেছে, সেটি প্রমাণ করা সহজ হবে, যদি প্রমাণ করা যায় ত্রিনিত্রি বিধ্বস্ত হবার পর সত্যি মহাকাশযানে বিপর্যয় নেমে এসেছিল।
সেটি কেমন করে প্রমাণ করবে?
রুখ স্থির দৃষ্টিতে ক্রিকির দিকে তাকিয়ে বলল, যদি দেখানো যায় শুধু শু নয়, আরো কেউ মারা গিয়েছিল।
ক্রিকি রক্তশূন্য মুখে রুখের দিকে তাকাল। রুশ সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার হাতে এক মিটার লম্বা স্টেনলেস স্টিলের একটা রড। ক্রিকির দিকে এক পা এগিয়ে এসে বলল, দেখাতে হবে বিপর্যয়টি ছিল ভয়ংকর, একাধিক মানুষ মারা গিয়েছে সেই বিপর্যয়ে। দেখাতে হবে শুধু শুয়ের মস্তিষ্কটি ছিল ব্যবহারযোগ্য, দেখাতে হবে মহাকাশযানের ভয়ংকর দুর্ঘটনায় তোমার মস্তিষ্কটি পুরোপুরি থেতলে গিয়েছিল।
ক্রিকি বাধা দেবার আগে প্রচণ্ড আঘাতে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
অশুভ মহাকাশযানের দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ডটি সম্পন্ন হল অমানুষিক নিষ্ঠুরতায়।
ইলি শীতল-কক্ষে তার নিজের ক্যাপসুলে শশায়ার আয়োজন করছে। পৃথিবীতে পৌঁছাতে এখনও দীর্ঘ সময় বাকি। ত্রিনিত্রি মহাকাশযানের যাবতীয় দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সাথে গ্রহণ করেছে, ইলির আর কন্ট্রোল-রুমের সামনে বসে থাকার প্রয়োজন নেই। মহাকাশযানের পরিবেশ অত্যন্ত গ্লানিময়। দুটি হত্যাকাণ্ড ঠাণ্ডা মাথায় শেষ করা হয়েছে ব্যাপারটি ভুলে থাকা সম্ভব নয়। ইলি শীতল-কক্ষে ঘুমিয়ে পড়বে দীর্ঘ সময়ের জন্যে। সবকিছু ভুলে থাকার জন্যে এর চাইতে ভালো আর কিছু হতে পারে না। রুখ শীতল-কক্ষে যেতে চাইছে না, দুটি হত্যাকাণ্ড তাকে খুব বিচলিত করেছে মনে হয় না। মানুষটি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করে। শুকে হত্যা করার পিছনে যুক্তিটি সহজ, ক্রিকিকে হত্যা করার যুক্তিটি তত সহজ নয়। কিন্তু ইলি অস্বীকার করতে পারে না যে, ক্রিকির ভিতরে গভীর একটা অপরাধবোধের জন্ম হয়েছিল এবং পৃথিবীতে পৌঁছানোর পর পুরো ব্যাপারটা প্রকাশ করে দেয়া তার জন্যে মোটেই অসম্ভব কিছু। নয়। নিঃসন্দেহে এখন তাদের জন্যে পৃথিবীতে পৌঁছানো অনেক বেশি নিরাপদ।
ক্যাপসুলের দরজা বন্ধ করে দেয়ার সাথে সাথে ভিতরে হালকা একটা নীল আলো জ্বলে ওঠে। ইলি মাথার কাছে সুইচ টিপে দিতেই ভিতরে শীতল একটা বাতাস বইতে থাকে। ত্রিনিত্রি তার শরীরের দায়িত্ব নিয়ে নেবে কিছুক্ষণের মাঝেই, গভীর নিদ্রায় অচেতন হয়ে যাবে সে দীর্ঘ সময়ের জন্য।