শু বলল, তার মানে এখন যদি আমাদের কাছে সেরকম ওষুধ থাকত, সেটা ব্যবহার করে আমাদের একজন ত্রিনিত্রির মতো হয়ে যেতে পারত?
ইলি একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, পারলেও খুব একটা লাভ হত না, কারণ এই মহাকাশযানের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত ত্রিনিত্রি। ত্রিনিত্রির মতো ক্ষমতাশীল একজন মানুষ দিয়ে খুব লাভ নেই–সেসব যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, তাকে যন্ত্রপাতির সাথে জুড়ে দেয়া যাবে না।
ক্রিকি বলল, ত্রিনিত্রির মূল সিপিইউতে যদি মানুষের একটা মস্তিষ্ক কেটে বসিয়ে দেয়া যায়?
ইলি শব্দ করে হেসে বলল, হ্যাঁ, তাহলে কাজ করবে। কিন্তু মানুষের শরীর থেকে সরিয়ে নেবার পর মস্তিষ্ক বেঁচে থাকে না। তা ছাড়া ত্রিনিত্রির সমস্ত যোগাযোগ ইলেকট্রনিক সিগনাল দিয়ে মানুষের মস্তিষ্কের যোগাযোগ অন্য রকম। এ ছাড়া অন্য রকম সমস্যা আছে, আমাদের কেউ তার মস্তিষ্ক দান করতে রাজি হবে বলে মনে হয় না।
ক্রিকি এবং শু হাসার ভঙ্গি করল। রুখ না হেসে স্থির দৃষ্টিতে ইলির দিকে তাকিয়ে রইল। ইলি বলল, রুখ, তুমি কিছু বলবে?
রুখ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সত্যিই একটা মানুষের মস্তিক ত্রিনিত্রির মূল সিপিইউ-তে বসিয়ে দেয়া যাবে?
তুমি কেন এটা জিজ্ঞেস করছ?
তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও যাবে?
ইলি উত্তর না দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুখের দিকে তাকাল। রুথ বলল, আমি একজন নিউরোসার্জন। আমি নেপচুনের কাছাকাছি একটি মহাকাশ স্টেশনে গিয়েছিলাম জটিল একটি সার্জারি করার জন্যে। আমি মানুষের মস্তিষ্ক কেটে বের করে দীর্ঘ সময় সেটা বাঁচিয়ে রাখতে পারি। মস্তিষ্ক পরীক্ষা করার জন্যে আমি সেটা থেকে ইলেকট্রনিক সিগনাল বের করে আনি। আমার কাছে তার জন্যে প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি রয়েছে। আমি যদি একটা মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রেখে সেটা থেকে ইলেকট্রনিক সিগনাল বের করে এনে দিই, তুমি কি ত্রিনিত্রির মূল সিপিইউ-তে সেটা বসিয়ে দিতে পারবে?
ইলির মুখে খুব ধীরে ধীরে একটা ধূর্ত হাসি ফুটে ওঠে। রুখের দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, তুমি কার মস্তিষ্ক নিতে চাও রুখ?
রুখ কোনো কথা না বলে ক্রিকি এবং শুয়ের দিকে তাকাল।
ক্রিকির মুখ হঠাৎ রক্তশূন্য হয়ে যায়। সে ফ্যাকাসে মুখে একবার ইলির দিকে, আরেকবার রুখের দিকে তাকাল, তারপর হঠাৎ কাতর স্বরে বলল, আমাকে মেরো না, দোহাই তোমাদের, আমাকে মেরো না। মেরো না, মেরো না–
কথা বলতে বলতে ক্ৰিকির গলা ভেঙে যায়, সে কাতর ভঙ্গিতে হাঁটু ভেঙে পড়ে যায়। ও ক্রিকিকে টেনে তুলে বলল, এত অস্থির হয়ো না ক্রিকি, ওঠ। তোমাকে মারবে কেন? এটা মহাকাশযান, পাগলা গারদ নয়। যার যা খুশি সেটা এখানে করতে পারে না।
রুখ শান্ত গলায় বলল, শু, আমি কিন্তু সত্যিই এটা চেষ্টা করে দেখতে চাই। ইলি যদি ইন্টারফেসটাতে সাহায্য করে, তাহলে সাফলার সম্ভাবনা শতকরা দশ ভাগের বেশি।
সাফল্যের সম্ভাবনা এক শ ভাগ হলে তুমি এটা করতে পার না রুখ। এটা মহাকাশযান। এখানে মানুষ রয়েছে, মানষের প্রাণ নিয়ে জুয়া খেলা হয় না।
তুমি পৃথিবীর আইনের কথা বলছ শু। এখন এখানে পৃথিবীর আইন খাটে —কিছু করা না হলে আমরা চারজনই মারা যাব। আমি তিনজনের প্রাণ বাঁচানোর কথা বলছি।
সেটা হতে পারে না।
পারে।
শু ইলির দিকে তাকিয়ে বলল, ইলি, তুমি কথা বলছ না কেন? তুমি এই মহাকাশযানের দলপতি।
আমার কিছু বলার নেই শু। ইলি রুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কার মস্তিষ্ক নিতে চাও রুখ? ক্রিকি, না শু?
আমি মেয়েদের মস্তিষ্কে কাজ করতে পছন্দ করি। আমার সর্বশেষ সার্জারিটিও ছিল একটি মেয়ের মস্তিষ্কে। মেয়েদের মস্তিষ্কের গঠন একটু ভিন্ন ধরনের, কাজটা একটু সহজ।
ইলি ধীরে ধীরে শুয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি দুঃখিত শু।
শু স্থির দৃষ্টিতে ইলির চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, ইলি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আবার বলল, আমি দুঃখিত শু।
শু ক্রিকির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলতে চাও ক্রিকি?
ক্রিকি মাথা নিচু করে বলল, একজনের প্রাণের বিনিময়ে যদি তিনজনের প্রাণ রক্ষা করা যায়, সেটার চেষ্টা করা তো দোষের নয়।
শু জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বাইরে মহাকাশে নিকষ কালো অন্ধকার, দূরে নীলাভ ইউরেনাস গ্রহ। শুয়ের বুকের ভিতর এক গভীর বিষণ্ণতা হা হা করে ওঠে।
সুইচটা অন করার সময় ইলির হাত কেঁপে গেল। গত দু সপ্তাহ রুখ এবং ইলি মিলে একটি প্রায় অসম্ভব কাজ শেষ করেছে। ক্রিকি নিজে থেকে কিছু করে নি, কিন্তু তাদের কাজে সাহায্য করেছে। মানুষের মস্তিষ্কের মতো জটিল জিনিস পৃথিবীতে খুব বেশি নেই, সেটাকে ত্রিনিত্রির অচল সিপিইউ-এর জায়গায় জুড়ে দেয়া খুব সহজ কাজ নয়। দু সপ্তাহের অমানুষিক পরিশ্রম সত্যিই সফল হয়েছে, নাকি একটি অপ্রয়োজনীয় হত্যাকাণ্ডের মাঝে সীমাবদ্ধ রয়েছে, আগে থেকে বলার কোনো উপায় নেই।
সুইচ অন করার কয়েক মুহূর্ত পরে যখন মহাকাশযানের ইঞ্জিন গুঞ্জন করে ওঠে এবং অসংখ্য মনিটরের উজ্জল আলোগুলো জ্বলে উঠে সবার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, তখন ইলি, রুখ এবং ক্রিকির আনন্দের সীমা রইল না। ইলি নিঃশ্বাস বন্ধ করে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ত্রিনিত্রি, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
ত্রিনিত্রি ধাতব স্বরে উত্তর দিল, শুনতে পাচ্ছি মহামান্য ইলি। আমাকে পূনর্জীবিত করার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ মহামান্য ইলি।