আমি শেষ পর্যন্ত টেলিফোনটা ধরলাম। মা ফোন করেছেন। জিজ্ঞেস করলেন, কে? কে কথা বলছ?
আমি ক্লান্ত স্বরে বললাম, আমি।
আমি কে?
আমি রিবাক।
কী আশ্চর্য, বলতে গিয়ে আমার গলার সুরকটু কেঁপে গেল হঠাৎ করে।
০৮. নরক
মহাকাশযানটিতে কোনো শব্দ নেই। শক্তিশালী ইঞ্জিনের গুঞ্জনে সবাই এত অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে হঠাৎ করে এই নৈঃশব্দ অসহনীয় মনে হয়। ক্রিকি নীরবতা ভেঙে বলল, এখন আমরা কী করব?
কথাটি ঠিক প্রশ্ন নয়, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো। কাজেই কেউ উত্তর দিল না। ক্রিকি আবার বলল, মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে কখনো এটা ঘটে নি। ঘটেছে?
এবারেও কেউ উত্তর দিল না। রুখ শুধু অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে কী-একটা বলল, কেউ ঠিক বুঝতে পারল না। ক্রিকি বলল, কিছু-একটা ভো করতে হবে। শুধু শুধু কি বসে থাকতে পারি?
শু দলের সবচেয়ে কোমল স্বভাবের সদস্যা। নীল চোখ, সোনালি চুল, মায়াবতী চেহারা। ক্রিকির প্রতি মায়াবশত বলল, কিছু না করাটাই হবে আমাদের জন্যে সবচেয়ে ভালো।
কেন? কেন সেটা বলছ?
আমরা সৌরজগতের সবচেয়ে নির্জন এলাকাটিতে আটকে পড়ে গেছি ক্রিকি। আমাদের রসদ সীমিত, কিছু-একটা করার চেষ্টা করা মানেই সে-রসদ অপচয় করা। আমাদের চেষ্টা করতে হবে বেঁচে থাকতে। কেউ-একজন বছর দুয়েক পর লক্ষ করবে যে আমাদের খোঁজ নেই। আরো কয়েক বছর পর আমাদের খুঁজে বের করবে। ততদিন আমাদের বেঁচে থাকতে হবে
মাত্র ছয় মাসের রসদ নিয়ে? ইলির অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার গলার স্বরে ব্যঙ্গটুকু প্রকাশ পেয়ে গেল।
শু মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
কী ভাবে শুনি।
আমাদের শীতল-ঘরে ঘুমিয়ে পড়তে হবে—অনির্দিষ্ট সময়ের জন্যে।
ত্রিনিত্রি নেই, সেটা ভুলে গেছ?
শু জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল, না, ভুলি নি।
ত্রিনিত্রি মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার। সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কোনো কারণে কম্পিউটারটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। মহাকাশযানের দলপতি এবং ঘটনাক্রমে কম্পিউটারের বিশেষজ্ঞ ইলি প্রাণপণ চেষ্টা করেও সেটাকে ঠিক করতে পারে নি। ত্রিনিত্রি যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, সম্ভবত সেটাকে আর ঠিক করার কোনো উপায় নেই। এই পুরো মহাকাশযানটি এবং তার খুঁটিনাটি সবকিছু ত্রিনিত্রির নিয়ন্ত্রণে ছিল। ত্রিনিত্রি বিধ্বস্ত হবার পর মহাকাশযানটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় ইউরেনাস ও নেপচুন গ্রহের মাঝামাঝি কোনো এক জায়গায় অজ্ঞাত এক উপবৃত্তাকার কক্ষপথে আটকে পড়ে গেছে। সেখান থেকে বের হয়ে আসা দূরে থাকুক, পৃথিবীতে খবর পাঠাবার জন্যে রেডিও যোগাযোগ পর্যন্ত করার কানো উপায় নেই।
ক্রিকি মহাকাশযানের কন্ট্রোলরুমে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ থেমে চাপা স্বরে, প্রায় আর্তনাদের মতো শব্দ করে বলল, কিন্তু আমাদের দ্বিতীয় কোনো কম্পিউটার নেই কেন?
কে বলেছে নেই? ইলি রুক্ষ স্বরে বলল, অবশ্যি আছে। ত্রিনিত্রি হচ্ছে সেই দ্বিতীয় কম্পিউটার। তৃতীয় কম্পিউটারও আছে, ত্রিনিত্রিই হচ্ছে সেই তৃতীয় কম্পিউটার। ত্রিনিত্রিই হচ্ছে চতুর্থ কম্পিউটার। তুমি ভুলে যাচ্ছ যে, ত্রিনিত্রি ডিজিটাল কম্পিউটার নয়—ত্রিনিত্রি মানুষের মস্তিষ্কের মতো করে তৈরী, এর একটা অংশ নষ্ট হলে অন্য আরেকটা অংশ কাজ করে
কিন্তু এখন কেন করছে না?
ইলি রুক্ষ স্বরে বলল, আমি জানি না। শুধু আমি না, পৃথিবীর কেউই জানে না। এই মহাকাশযানটি যদি পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারে তাহলে কম্পিউটারের ইতিহাস আবার নূতন করে লিখতে হবে।
মহাকাশযানের চারজন সদস্য-সদস্যা। এর মাঝে সবচেয়ে অল্পবয়ষ্ক হচ্ছে ক্রিকি। দলের নেতা ইলি মধ্যবয়স্ক এবং মহাকাশ অভিযানে সবচেয়ে অভিজ্ঞ সদস্য। একমাত্র মহিলা হচ্ছে শু। দলের চতুর্থ সদস্য হচ্ছে স্বল্পভাষী রুখা মহাকাশযানটি আন্তঃগ্রহ আকরিক পরিবহনের দায়িত্ব পালন করে, প্রয়োজনে একজন বা দুজন যাত্রী আনা-নেয়া করে। এই মহাকাশযানে রুখ সেরকম একজন যাত্রী, ব্যক্তিগত জীবনে নিউরোসার্জন, মহাকাশ অভিযানের বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্পর্কে তার কোনোরকম অভিজ্ঞতা নেই।
রুখ দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, ইলি, তুমি বলেছ ত্রিনিত্রি কম্পিউটার মানুষের মস্তিষ্কের মতো করে তৈরি করা হয়েছে?
হ্যাঁ।
মানুষের মস্তিষ্কের কত কাছাকাছি অনুকরণ করে বলে মনে কর?
আমি মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে কখনো কাজ করি নি তাই আমি জানি না। কিন্তু বলা হয়ে থাকে, এটি মানুষের মস্তিষ্কের অবিকল অনুকরণ। যে-ইলেকট্রনিক সেলগুলো মানুষের মস্তিষ্কের নিউরনকে অনুকরণ করে, তার সংখ্যা অবশ্যি অনেক কম, বুঝতেই পারছ, মানুষের মস্তিষ্কে কত লক্ষ কোটি নিউরন থাকে—
ক্রিকি জিজ্ঞেস করল, নিউরনের সংখ্যা এত কম হবার পরেও ত্রিনিত্রি এত শক্তিশালী কম্পিউটার কেন? আমরা ত্রিনিত্রির ক্ষুদ্র ভগ্নাংশও তো করতে পারি না।
রুখ ক্রিকির দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের করার ক্ষমতা রয়েছে, আমরা করতে পারি না, কারণ করার প্রয়োজন নেই। বিবর্তনের ফলে আমরা এরকম পর্যায়ে এসেছি। অন্য কোনো পরিস্থিতিতে মানুষ অন্য রকমও হতে পারত। মাঝে মাঝে সেরকম মানুষ দেখা যায় প্রকৃতির খেয়ালে। তারা অসাধারণ কাজ করতে পারে। আজকাল নূতন ওষুধ বের হয়েছে, সেটা দিয়ে মস্তিষ্ক পাল্টে দিয়ে ত্রিনিত্রির মতো করে দেয়া যায়।
তা হলে সেটা করা হয় না কেন?
কারণ সেরকম অবস্থায় নিউরন সেল খুব অল্প সময় বেঁচে থাকে। নিউরন সেল একবার ধ্বংস হলে নূতন সেলের জন্ম হয় না।