না, কিছু হয় নি। আমি কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিলাম, গতকাল আমি মাকে ফোন করি নি।
তোমার কী খবর? শরীরের যত্ন নিচ্ছ তো?
হ্যাঁ, নিচ্ছি।
একা একা আর কতদিন থাকবে?
মা, একটা কথা।
কী কথা?
তুমি আমার লেখা একটা চিঠি পেয়েছ মনে আছে?
হ্যাঁ। কী হয়েছে? কালকেও—
কালকে কী?
কালকেও এই চিঠি নিয়ে ফোন করলে–
আমি থতমত খেয়ে থেমে গেলাম। মা বললেন, কী বলবে বল চিঠি নিয়ে। নাকি আজকেও বলবে না?
আমি ইতস্তত করে বললাম, না, আজ আক। তোমার সাথে পরে কথা বলব।
ফোনটা রেখে দিতেই রবোটটা ঘুর করে আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। শুনলাম বিড়বিড় করে বলছে, ঠিক হল না। মাকে এভাবে চিন্তার মাঝে ফেলে দেয়া একেবারেই ঠিক হল না।
আমি থ হয়ে বসে রইলাম, কারণ আমি ঠিক এই জিনিসটাই ভাবছিলাম।
রাত বারটার সময় আমার এক দার্শনিক বন্ধু ফোন করল, আমি নিজে কয়দিন থেকে তাকে ফোন করব বলে ভাবছিলাম। বন্ধুটি বলল, তুমি ঠিকই বলেছ রিবাক।
কী ঠিক বলেছি? বন্ধুটির কথাবার্তা সবসময় হেঁয়ালিপূর্ণ হয়, তার কথায় আমি বেশি অবাক হলাম না।
দ্বৈত অস্তিত্ব।
মানে?
মানুষের দ্বৈত অস্তিত্ব। বন্ধুটি একটু বিরক্ত হয়ে বলল, আমি বলছি যে আমি তোমার সাথে একমত। একজন মানুষের যদি হঠাৎ করে দুটি ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্বের সৃষ্টি হয় তা হলে একটির ধ্বংস হয়ে যেতে হবে। দুটি অস্তিত্ব একসাথে থাকতে পারবে না।
কেন?
কারণ মানুষের মূল প্রকৃতি হচ্ছে আত্মসচেতনতা। নিজের সম্পর্কে সচেতন হওয়ার আরেক নাম অস্তিত্ব। কাজেই আত্মসচেতনতা বিলুপ্ত করে মানুষের প্রকৃতি বেঁচে থাকতে পারে না। আত্মসচেতনতার জন্যে সবচেয়ে প্রথম দরকার কী? ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব।
বন্ধুটি একনাগাড়ে কথা বলে যেতে থাকে। আমি হঠাৎ করে তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমাকে কেন এসব কথা বলছ?
তুমি জানতে চাইলে, তাই।
আমি কখন জানতে চাইলাম?
কেন, কাল রাতে? কাল রাতে আমার সাথে এত তর্ক করলে। তখন মনে হচ্ছিল তুমি ভুল বলছ। কিন্তু আমি পরে চিন্তা করে দেখেছি যে, না, তুমি ঠিকই বলেছ। সত্যি কথা বলতে কি এর উপর দার্শনিক লীফার একটা সূত্র আছে
বন্ধুটি একটানা কথা বলে যেতে থাকে, সে কী বলছে, আমি ঠিক খেয়াল করে শুনছিলাম না, কারণ রবোটটি আবার ঘুরঘুর করে ঘরে হাজির হয়েছে। আমি কাল এই বন্ধুটিকে ফোন করি নি, এই রবোটটি করেছে। আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রবোটটিকে দেখি। ভাবলেশহীন যন্ত্রের মুখে কোনো অনুভূতির চিহ্ন নেই, জ্বলজ্বলে চোখে কপোট্রনিক উল্য থাকতে পারে, কিন্তু প্রাণের ছোঁয়া নেই। কিন্তু এই যন্ত্রটির সাথে আমার কোনো পার্থক্য নেই। আমি যেভাবে ভাবি, যেভাবে চিন্তা করি, এই যন্ত্রটিও ঠিক সেরকম করে ভাবে, সেরকম করে চিন্তা করে। আমার অনুভূতি যে-সুরে বাঁধা, এর অনুভূতিও ঠিক সেই সুরে বাঁধা। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই যন্ত্রটি মনে করে সে-ই হচ্ছে আমি রিবাক। হঠাৎ করে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারি রবোটটাকেশষ করে দেবার সময় হয়েছে।
দার্শনিক বন্ধু যে-জিনিসটি বলেছে, সেটা হয়তো সত্যি। যদি কখনো একজন মানুষের দুটি অস্তিত্ব হয়ে যায়, তা হলে একজনকে ধ্বংস হয়ে যেতে হবে। দুটি অস্তিত্ব পাশাপাশি থাকতে পারে না। দু জন ঠিক একই জিনিস ভাববে, একই জিনিস করবে, তার থেকে জটিল ব্যাপার আর কী হতে পারে? সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার অন্য জায়গায়, যদি কখনো দুটি অস্তিত্বের সৃষ্টি হয় একই সাথে, দুটি অস্তিত্বই একজন আরেকজনকে ধ্বংস করার কথা ভাববে।
আমি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে ঘরের মাঝে ছটফট করতে থাকি। এরকম একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে যে আমি পড়ব, কখনো কল্পনা করি নি। এই মুহূর্তে পাশের ঘরে বসে নিশ্চয়ই আমার অন্য অস্তিত্বটি আমাকে কী ভাবে ধ্বংস করবে সেটা চিন্তা করছে। কী ভয়ানক ব্যাপার, আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় শিউরে ওঠে। কিন্তু সেটা তো কিছুতেই ঘটতে দেয়া যায় না, আমার নিজেকে রক্ষা করতেই হবে, যে-কোনো মূল্যে। আমাকে আঘাত করার আগে তাকে আঘাত করতে হবে।
আমি আমার সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে চিন্তা করতে থাকি। কিছু-একটা ভেবে বের করতে হবে। কপোট্রনের সাইকেল এখনো গেগা হার্টজে আছে, আমি সেটাকে দ্বিগুণ করে দিলাম। চিন্তা করার জন্যে বড় প্রসেসর আলাদা করা থাকে, আমি সেগুলোকে মূল মেমোরির সাথে জুড়ে দিলাম। চোখের দৃষ্টি এখন আর সাধারণ রাখা যাবে না, কপোট্রনে সিগনাল পাঠাতেই আমার দৃষ্টি ইনফ্রারেড আলোতে সচেতন হয়ে গেল, আমি এখন অন্ধকারেও দেখতে পাব। শ্রবণশক্তিকে আরো তীক্ষ্ণ করে দেয়া যাক, এক শ ডেসিবেলের বেশি বাড়ানো গেল না, ঘরের কোনায় মাকড়সার পদশব্দও এখন আমি শুনতে পাচ্ছি।
আমি চারদিকে ঘুরে তাকালাম একবার। আমার অন্য অস্তিত্ব এখন হঠাৎ করে আমার উপর ঝাঁপাতে পারবে না। আমি আমার যান্ত্রিক হাত দুটির একটি উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। বাড়তি বিদ্যুৎপ্রবাহ পাঠিয়ে সেটাকে আরো শক্তিশালী করে দেব কি? আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকি।
অনেকক্ষণ থেকে টেলিফোন বাজছে। টেলিফোন জিনিসটা আমার মোটে পছন্দ নয়, আজকাল টেলিফোনে কত রকম কারুকাজ করা যায়, ত্রিমাত্রিক ছবি থেকে শুরু করে স্পর্শানুভূতি—কী নেই। আমি নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করি, আমার টেলিফোনে ভাই শুধু কথা বলা যায়, আর কিছু করা যায় না। কিন্তু এখন কথা বলারও ইচ্ছা করছে না। যদি টেলিফোনটা না তুলি, হয়তো একসময় বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু বন্ধ হল না। টেলিফোনটা বেজেই চলল।