রাতে যখন ঘুমাতে গেলাম তখন অবাক হয়ে দেখলাম, আমি অসাধ্য সাধন করেছি। এক পৃষ্ঠা নয়, পুরো একটি অধ্যায় লিখে ফেলেছি। নিজের উপর বিশ্বাস বেড়ে গেল হঠাৎ করে।
পরদিন রাতে আমি আবার লিখতে বসেছি, লেখা শুরু করার আগে যেটুকু লেখা হয়েছে সেটা আরেকবার পড়ে দেখলাম। নিজের লেখা পড়ে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমি। চমৎকার ভাষা, সুন্দর উপস্থাপনা, কাহিনীর গাঁথুনি শক্তিশালী লেখকদের মতো। শুধু তাই নয়, আমি যেটুকু লিখেছি ভেবেছিলাম, দেখলাম তার থেকে অনেক বেশি লিখে রেখেছি। আমি প্রবল উৎসাহে আবার লেখা শুরু করে দিলাম। কাহিনী দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে, রিকি নামের ক্ষ্যাপা গোছের মূল চরিত্রটি নীষা নামের সেই মেয়েটির সাথে জটিল একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আমি তৃতীয় একটা চরিত্র সৃষ্টি করলাম, কুশাক নামের। লেখা এগুতে থাকে আমার। আমি তাকিয়ে দেখি নি, কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই যে, রবোট কাছাকাছি কোথাও দাঁড়িয়ে আমার লেখাঁটি পড়ছে।
সে-রাতে ঘুমানোর সময় আমি কাহিনীর পরবর্তী অংশ ভাবতে থাকি। একটা হত্যাকাণ্ড ঘটাতে হবে এখন, ভয়ংকর নৃশংস একটা হত্যাকাণ্ড। বড় ধরনের সাহিত্যে সবসময় একটা হত্যাকাণ্ড থাকে।
পরের রাতে আমি লিখতে বসে অবাক হয়ে দেখলাম, কাহিনীর জন্যে ভেবে রাখা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি আমি আসলে ইতোমধ্যে লিখে রেখেছি। কখন লিখলাম মনে করতে পারলাম না, কী লিখব ভেবে রেখেছিলাম, কিন্তু দেখা যাচ্ছে শুধু ভেবে রাখি নি, আসলে লিখে রেখেছি। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? আমি বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম, এটা কেমন করে হতে পারে যে আমি এত বড় একটা অংশ লিখে রেখেছি, অথচ আমার মনে পর্যন্ত নেই। আমি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে আবার লিখতে শুরু করি, আমার ঠিক পিছনে রবোটটা দাঁড়িয়ে আছে।
কয়েক লাইন লিখেছি, হঠাৎ অবাক হয়ে লক্ষ করি রবোটটা ফিসফিস করে কী যেন বলছে। খেয়াল করে শুনি, সে বলে দিচ্ছে কী লিখতে হবে। আমি নিজে যেটা লিখব বলে ঠিক করেছি ঠিক সেটাই সে বলছে। আমি ভীষণ চমকে পিছনে তাকালাম, বললাম, কী বললে? কী বললে তুমি?
নীষার চোখে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ খেলা করতে থাকে।
নীষার চোখে—
নীষার চোখে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ খেলা করতে থাকে। প্রচণ্ড আক্রোশে তার চিন্তা—
তুমি কেমন করে জানলে আমি এটা লিখব? কেমন করে জানলে?
রবোটটা প্রশ্নের উত্তর দিল না, কখনো দেয় না। আবার ফিসফিস করে বলল, নীষার চোখে–
আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি কেমন করে আমার অজান্তে লেখা হয়ে গেছে। বিস্ময়ের আকস্মিকতায় আমার নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে মনে থাকে না। কোনোমতে বললাম, তুমি এখানে লিখেছ? এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি লিখেছ? আমার লেখার মাঝখানে।–
আমার লেখার মাঝখানে। রবোটটি মাথা নাড়ে, আমার লেখার মাঝখানে।
আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকি। হুবহু আমার ভাষায় আমার ভঙ্গিমায় আমার তৈরি করে রাখা কাহিনী লিখে রেখেছে এই রবোট। কেমন করে জানল আমার মনের কথা।
আমি একা লিখলে উপন্যাসটি শেষ হত কিনা সন্দেহ, কিন্তু রবোটের সাহায্যে সেটা শেষ হয়ে গেল। আমি গোটা কয়েক কপি করে বিভিন্ন প্রকাশককে পাঠিয়ে দিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে কেউ-না-কেউ সেটা প্রকাশ করতে রাজি হবে, কিন্তু সবগুলি ফেরত এল। না পড়ে ফেরত দিয়েছে দাবি করব না, কারণ সাথের চিঠিতে হা বিতং করে লেখা উপন্যাসটি কেন তারা ছাপকিউপযুক্ত মনে করে নি। ভদ্র ভাষায় লিখেছে, কিন্তু পরিষ্কার বলে দিয়েছে, অবাস্তব কাহিনী, অপরিপক্ক বাচনভঙ্গি এবং দুর্বল ভাষা।
ব্যাপারটি নিয়ে বেশি বিচলিত হবার সময় পাওয়া গেল না, কারণ রবোটটি নিয়ে আরো নানারকম জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। আমার হয়ে নানারকম বইপত্র অর্ডার দেয়া এবং সে জন্যে আমার চেকে হুবহু আমার মতো নাম সই করা, এ ধরনের ব্যাপার সহ্য করা সম্ভব। কিন্তু সে আমার মায়ের সাথে যে জিনিসটি করল, সেটা কিছুতেই সহজভাবে নেয়া সম্ভব নয়।
আমার মা, যিনি বাবার মৃত্যুর পর দক্ষিণের উষ্ণ সমুদ্রোপকূলে দীর্ঘদিন থেকে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন, আমাকে সুদীর্ঘ একটা চিঠি লিখলেন। চিঠির মূল বক্তব্য হচ্ছে যে, তিনি আমার হাতের লেখা সুদীর্ঘ চিঠিটি পেয়ে অভিভূত হয়েছেন। আমি শৈশবের যেসব ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছি, সেসব ঘটনা তাঁর জীবনেরও মূল্যবান স্মৃতি। চিঠির শেষে তাঁর সাথে এত বিলম্বিত যোগাযোগের জন্যে মৃদু তিরস্কারও আছে। আমি তাঁকে গত কিছুদিন থেকে একটা লম্বা চিঠি লিখব বলে তাবছিলাম, কিন্তু সময়ের অভাবে সেই চিঠিটা লেখা হয়ে ওঠেনি। রবোটটির সময় নিয়ে সমস্যা নেই, সে আমার হয়ে আমার হাতের লেখায় আমার মাকে এই চিঠিটা লিখে দিয়েছে।
আমি বেশ বিচলিত হয়ে উঠলাম। রবোটটির আমাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করার ব্যাপারটি এতদিন খানিকটা কৌতুকের মতো ছিল, এখন হঠাৎ করে কৌতুকটা উবে গিয়ে সেটাকে প্রতারণার মতো দেখাতে লাগল। আমার মা যে-চিঠিটি পেয়ে এত অভিভূত হয়েছেন, সেটি অনুভূতিহীন একটি রবোটের যান্ত্রিক কৌশলে লেখা জানতে পারলে আমার মা কী ধরনের আঘাত পাবেন চিন্তা করে আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠি।
ব্যাপারটি আরো বেশিদূর অগ্রসর হবার আগে আমি মায়ের সাথে কথা বলে। ব্যাপারটির নিত্তি করব বলে ঠিক করে নিলাম।
আমার মা টেলিফোন পেয়ে খুশি হওয়ার থেকে বেশি অবাক হলেন বলে মনে হল, বললেন, কী ব্যাপার রিবাক? কালকেও একবার ফোন করলে, আজ আবার? কিছু কি হয়েছে?