রবোটটা আমার সাথে ফিসফিস করে বলল, ফুল।
আমি কেন জানি সুইচ অফ করে রবোটটাকে বিকল করে দিতে পারলাম না। এটি একটি সাবধানী, নিরীহ এবং অত্যন্ত কৌতূহলী রবোট, এর আচার-আচরণ শিশুদের মতো। দেখে আমার কোনো সন্দেহ রইল না যে, একে বিকল করে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। রবোটটিকে ঘুরঘুর করে ঘুরতে দিয়ে আমি আমার রগরগে বইটি নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
সকালে উঠে প্রথমে রবোটটিকে খুঁজে পেলাম না, ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। কাজেই সে বাইরে যায় নি, ভিতরই কোথাও আছে। খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত আমি তাকে বসার ঘরে তার বাক্সের মাঝে আবিষ্কার করলাম। সেখানে সেটি চোখ বন্ধ করে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। আমি এর আগে কোনো রবোটকে ঘুমাতে দেখি নি।
আমার পায়ের শব্দ শুনে রবোটটা চোখ খুলে আমার দিকে তাকাল, তারপর ফিসফিস করে বলল, ফুল।
আমার পক্ষে হাসি আটকে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াল, আমাকে এর আগে কেউ ফুল বলে সম্বােধন করেছে বলে মনে পড়ে না। রবোটটা সম্পর্কে কয়েকটা জিনিস এতক্ষণে বেশ স্পষ্ট হয়েছে, তার একটা হচ্ছে, আমি তার সাথে যে-কয়টা কথা ব্যবহার করেছি, এটি শুধুমাত্র সেই কথাগুলোই শিখেছে। কথাবার্তায় ঘুরেফিরে শুধু সেই কথাগুলোই ব্যবহার করেছে। তা ছাড়া এটাকে দেখে মনে হচ্ছে, এর কপোট্রনে। আগে থেকে কোনোরকম বিশেষ জ্ঞান দেয়া হয় নি। সম্ভবত অত্যন্ত ক্ষমতাশালী একটা কপোট্রন এবং নূতন কিছু দেখে সেটা শেখার একটা ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। মানবশিশুরা যেরকম দেখে দেখে শেখে, এটাও সেরকম। আমি স্বীকার না করে পারলাম না এ ধরনের রবোটের কোনোরকম ব্যবহারিক গুরুত্ব সম্ভবত নেই, কিন্তু এর বুদ্ধিমত্তা কী ভাবে বিকাশ করে সেটি লক্ষ করা খুব চমৎকার একটি ব্যাপার হতে পারে।
রবোটটিকে জঞ্জালের বাক্সে ফেলে দিয়ে ধ্বংস করার পরিকল্পনাটি আপাতত কিছুদিনের মাঝে আমি রবোটটা সম্পর্কে আরো কিছু আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করলাম। তার একটি বেশ বিচিত্র, রবোটটার সাথে কোনোরকম কথোপকথন করা যায় না। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই সে প্রশ্নটি গভীরভাবে চিন্তা করতে শুরু করে, কিন্তু তার উত্তর দেয়ার কোনো চেষ্টা করে না। আমাকে সে খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে, আমার প্রতিটি কথা, আচার-আচরণ, ভাবভঙ্গি সে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করার চেষ্টা করে। একসময় লক্ষ করলাম, তার কণ্ঠস্বর অবিকল আমার মতো হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, তার উচ্চারণেও ঠিক আমার মতো মধ্যদেশীয় আঞ্চলিকতার একটা সূক্ষ্ম টান। আমি যে-বই পড়ি বা যে-সঙ্গীত শুনি, রবোটটাও সেই বই পড়ে এবং সেই সঙ্গীত শোনে। আমি যেরকম মাঝে মাঝে লেখালেখি করার চেষ্টা করি, সেও সেরকম লেখালেখি করে। সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে, তার টানা হাতের লেখা অবিকল আমার হাতের লেখার মতো। একটামাত্র জিনিস সে করতে পারে না, সেটা হচ্ছে খাওয়া, কিন্তু আমি যখন কিছু খাই সে গভীর মনোযোগ দিয়ে আমাকে লক্ষ করে।
আমি এর আগে কোনো রবোটকে আমার কাছাকাছি দীর্ঘসময় রাখতে পারি নি, কিন্তু এর বেলায় আমার কোনো অসুবিধে হল না। যেহেতু তার সাথে কোনো কথোপকথন হয় না, সে কখনো আমাকে কোনো প্রশ্ন করে না, আমাকে কোনো কাজে সাহায্য করতে চায় না, কখনোই কোনো ব্যাপারে মত প্রকাশ করে না, কাজেই তার অস্তিত্ব আমি মোটামুটিভাবে সবসময় ভুলে থাকি। প্রথম দিকে রবোটটিকে আমি একটা নাম দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কোনো লাভ হল না। রবোটটির আমার থেকে আলাদা কোনো পরিচিত নেবার ক্ষমতা নেই। এর কপোট্রনটি সম্ভবত সেভাবেই প্রোগ্রাম করা হয়েছে যাকে অনুকরণ করবে তাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করবে। আমি অত্যন্ত চমৎকৃত হয়ে লক্ষ করলাম যে সে অনুকরণের অংশটি অত্যন্ত সুচারুভাবে করে আসছে।
ভালো কিছু পড়লে সবসময় আমার ভালো কিছু একটা লেখার ইচ্ছা করে। আমি অনেকবারই লেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কখনোই বেশিদূর অগ্রসর হতে পারি নি, পৃষ্ঠাখানেক লেখার পর আমার লেখা আর অগ্রসর হতে চায় না। যেটুকু হয় সেটা যে খুব খারাপ হয় তা নয়। ভাষার উপর আমার মোটামুটি একটা দখল আছে এবং কোনো একটা জিনিস প্রকাশ করার আমার নিজস্ব একটা ভঙ্গি রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে প্রতিবারই প্রথম পৃষ্ঠার পর আমার লেখা বন্ধ হয়ে এসেছে। সাহিত্যজগতে অসংখ্য লেখার প্রথম পৃষ্ঠা নিয়ে কেউ বেশিদূর অগ্রসর হয়েছে বলে জানা নেই, কিন্তু তবু আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। কে জানে হয়তো কখনো সত্যি বড় কিছু-একটা লিখে ফেলতে পারব।
প্রাচীনকালের পটভূমিকায় লেখা একটা অত্যন্ত শক্তিশালী উপন্যাস শেষ করে আমি অভ্যাসবশত আমার কম্পিউটারের সামনে বসে সম্ভবত একবিংশবারের মতো একটি উপন্যাস লেখা শুরু করেছি। উপন্যাসটি শুরু হয়েছে এভাবে :
তাকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না, কিন্তু রিকির মন অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত। অন্ধকার রাত্রিতে খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রিকি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিল, তখন কারো পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না, কিন্তু সেটি তার জীবনকে পুরোপুরিভাবে পাল্টে দিল…।
উপন্যাসটি বেশ এগুতে শুরু করল। পাঠকদের মনোেযোগ আকর্ষণ করার পর রিকি নামক চরিত্রটিকে উপস্থাপন করা হল। জটিল একটা চরিত্র তীব্র আবেগবান ক্ষ্যাপা গোছের একজন তরুণ। চরিত্রটির জীবনে নীষা নামের একটি মেয়ের উপস্থিতি এবং সেটা নিয়ে আরো বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হতে শুরু করল। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে লিখতে থাকি, আমার ঘাড়ের উপর দিয়ে রবোটটি স্থির দৃষ্টিতে মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে সবসময় আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে, তার উপস্থিতির কথা আজকাল আমার মনে পর্যন্ত থাকে না।