আমার বাসাটি ছোট, একা থাকি, কাজেই বড় বাসার কোনো প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করি নি। বসার ঘরে রবোটের এই অতিকায় বাক্সটি অনেকটুকু জায়গা নিয়ে নিচ্ছে। কাজেই প্রথমেই এটাকে জঞ্জালে ফেলার আমি একটা চমৎকার পদ্ধতি বের করেছি। বাক্স থেকে বের করে বলি, তুমি তোমার বাক্সটি নিয়ে জঞ্জালের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়।
কোন মডেলের রবোট, তার উপর নির্ভর করে কখনো কখনো আরো কিছু কথাবার্তা হয়। শেষ রবোটটি বলেছিল, আপনি কি সত্যিই চান আমি এটা করি?
হ্যাঁ, আমি চাই।
কিন্তু এটা কি অত্যন্ত অযৌক্তিক একটি আদেশ নয়?
সম্ভবত, কিন্তু তবু তুমি জঞ্জালের বাক্সে ঝাঁপ দাও।
রবোটটি এগারতলা থেকে জঞ্জালের বাক্সে ঝাঁপ দিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবার আগে আমাকে আরো একবার জিজ্ঞেস করেছিল, মহামান্য রিবাক, আপনি কি সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা করে আমাকে এই আদেশটি দিচ্ছেন?
হ্যাঁ, আমি সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা করে তোমাকে এই আদেশ দিচ্ছি।
রবোটটি আমার সম্পর্কে একটা অত্যন্ত অসম্মানজনক উক্তি করে এগারতলা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল।
এবারেও তাই করার জন্যে আমি বাক্স খুলে রবোটটিকে বের করে তার কানের নিচে স্পর্শ করে সুইচটা অন করে দিলাম। রবোটের কপোট্রনের ভিতর থেকে খুব হালকা একটা গুঞ্জনের শব্দ শোনা গেল এবং কয়েক সেকেন্ডের ভিতরেই তার ফটোসেলের চোখে রবোটসুলভ চাঞ্চল্য দেখা গেল। রবোটটি উঠে দাঁড়ানোর কোনো চেষ্টা করল না, বাক্সের মাঝে শুয়ে থেকে জ্বলজ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আগে কখনো এ ধরনের ব্যাপার ঘটে নি।
আমি বললাম, উঠে দাঁড়াও।
রবোটটি বাক্সের মাঝে শুয়ে থেকেই আমার দিকে তাকিয়ে রইল, উঠে দাঁড়ানোর না।
অবাধ্য রবোট তৈরি করা কি রবোট শিল্পের নতুন ধারা? আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, আবার বললাম, ওঠ।
রবোটটি ফিসফিস করে বলল, ওঠ।
আমি বললাম, উঠে বস।
রবোটটি ফিসফিস করে বলল, উঠে বস।
আমি একটু অবাক হলাম, যে-কোম্পানি আমাকে রবোটটা পাঠিয়েছে বলা যেতে পারে তারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রবোট-নির্মাতাদের একটি। আমার সাথে কোনোরকম রসিকতা করার চেষ্টা করবে না, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রবোটটা অন্য দশটা রবোটের মতো নয় বলাই বাহুল্য, আকারে মানুষের সমান, বেমানান বড় মাথা, বড় বড় সবুজ রঙের চোখ, কথা বলার জন্যে সংবেদনশীল স্পীকার, থামের মতো একজোড়া পা এবং অত্যন্ত সাধারণ সিলিন্ডারের মতো শরীর। তবে এর আচার-আচরণ অন্য দশটা রবোট থেকে ভিন্ন, এবং নিশ্চিতভাবেই এর কোনো এক ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে, কিন্তু সেটা ঠিক কি, আমি বুঝতে পারলাম না। আমি রাতের খাবার শেষ করে আবার রবোটটাকে নিয়ে বসব ঠিক করে খাবার ঘরে চলে এলাম।
ভালো খেতে খুব যে বেশি পরিশ্রম করতে হয় সেটি সত্যি নয়। কিন্তু যেটুকু করতে হয়, আমি সেটাও করতে রাজি নই। তাই প্রায় প্রতিরাতেই আমি একই ধরনের বিস্বাদ কিন্তু মোেটামুটি পুষ্টিকর খাবার খেয়ে থাকি। খাবার সময় আমি সাধারণত একটা ভালো বই নিয়ে বসি, পড়ার মাঝে ডুবে গেলে খাওয়া ব্যাপারটি আর সেরকম যন্ত্রণাদায়ক মনে হয় না। বিংশ শতাব্দীর পটভূমিকায় লেখা একটা রগরগে খুন জখমের বই শুরু করেছি। আমি সেটা হাতে নিয়ে খাবার টেবিলে এলাম।
খাবারের শেষ পর্যায়ে এবং বইয়ের মাঝামাঝি অংশে হঠাৎ একটা শব্দ শুনে আমি মুখ তুলে তাকালাম। দেখি রবোটটা তার বাক্স থেকে বের হয়ে এসেছে। আগে লক্ষ করি নি, প্রচলিত রবোটের মতো এটি পদক্ষেপ করতে পারে না। পায়ের নিচে ঘোট ঘোট চাকা রয়েছে, সেগুলো ঘুরিয়ে এটি সামনে-পিছে যায়। রবোটটা প্রায় নিঃশব্দে আমার ঘরে এসে ঢুকেছে, আমাকে মুখ তুলে তাকাতে দেখে সেটা সন্তর্পণে আমার দিকে এগিয়ে এল। কাছাকাছি এসে সেটি তার হাত তুলে খুব সাবধানে আমার হাতকে স্পর্শ করল। আমি হঠাৎ করে লক্ষ করলাম রবোটটার হাত দুটি অত্যন্ত যত্ন করে তৈরি করা হয়েছে, অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু এর দুটি হাত প্রায় মানুষের হাতের মতো। শুধু তাই নয়, হাতের স্পর্শটি ধাতব এবং শীতল নয়, জীবন্ত প্রাণীর মতো উষ্ণ এবং কোমল। আমি বললাম, এখান থেকে যাও।
রবোটটি আমার কথা বুঝতে পারল বলে মনে হল না। ফিসফিস করে বলল, যাও।
খানিকক্ষণ আমার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ সেটি ঘরের কোনার দিকে হেঁটে গেল। সেখানে প্রাচীন মায়া সভ্যতা থেকে উদ্ধার করা একটি সূর্যদেবতার মূর্তি সাজানো আছে। রবোটটি মূর্তিটার সামনে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে সেটি লক্ষ করতে থাকে। ধীরে ধীরে সে হাত বাড়িয়ে মূর্তিটিকে স্পর্শ করে। তারপর ঘুরে আমার দিকে তাকায়। আবার মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে, ওঠ।
রবোটটির আচার-আচরণে একটা শিশুসুলভ ভাব রয়েছে। আমি খানিকক্ষণ সেটা লক্ষ করে আবার আমার রগরগে খুন-জখমের বইয়ে ডুবে গেলাম।
রাতে ঘুমানোর আগে বোটটির ব্যাপারে কিছু-একটা নিষ্পত্তি করার কথা ভাবছিলাম। যদি আজ রাতে জঞ্জালের বাক্সে নাও ফেলি, অন্তত সুইচ অফ করে সেটাকে বিকল করে রাখা দরকার। আমি রবোটটাকে আমার লাইব্রেরি-ঘরে আবিষ্কার করলাম, সেটি টেবিলের উপর রাখা ফুলের তোড়াটি গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছে। একবার একটু কাছে থেকে দেখে তারপর আবার আরেকটু দূর থেকে দেখে। একবার মাথাটি ডানদিকে কাত করে দেখে, তারপর আবার বাম দিকে কাত করে দেখে। মাঝে মাঝে খুব সাবধানে ফুলটাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করে। রবোটের এরকম একাগ্রতা আমি আগে কখনো দেখি নি। আমার পায়ের শব্দ শুনে সেটি আমার দিকে ঘুরে তাকাল এবং হাত দিয়ে ফুলটিকে দেখিয়ে একটা অবোধ্য শব্দ করল, ঘোট শিশুরা যেরকম অর্থহীন অবোধ্য শব্দ করে অনেকটা সেরকম। রববাটের ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না যে, সে আগে কখনো ফুল দেখে নি। আমি ফুলটা দেখিয়ে বললাম, ফুল।