প্রফেসর রাউখ।
অপরিচিত একটা গলার স্বরে প্রফেসর রাউখ চমকে উঠে সামনে তাকান। ঘরের মাঝামাঝি আবার সেই চতুষ্কোণ নীলাভ আলো। তার মাঝে একজন মানুষের মুখমণ্ডল। মানুষটি বিষণ্ণ মুখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। প্রফেসর রাউখ নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলেন, তিনি কি সত্যি দেখছেন?
মানুষটি আবার ফিসফিস করে ডাকল, প্রফেসর রাউখ।
মানুষটির বিষণ্ণ চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ প্রফেসর রাউখ সবকিছু বুঝে গেলেন। আটকে থাকা নিঃশ্বাসটি আস্তে আস্তে বুক থেকে বের করে বললেন, তুমি অনিশ্চিত জগতের অধিবাসী?
হ্যাঁ প্রফেসর রাউখ। নীলাভ চতুষ্কোণের ছায়ামূর্তি যান্ত্রিক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, আমরা অনিশ্চিত জগতের অধিবাসী, আমরা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।
প্রফেসর রাউখ দেখলেন, ছায়ামূর্তির পিছনে আরো অনেক মানুষের চেহারা। খুব ধীরে ধীরে তার মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে। আস্তে আস্তে বললেন, তোমরা তোমাদের অনিশ্চিত জগৎকে রক্ষা করার জন্য আমার কাছে এসেছ?
আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন প্রফেসর রাউখ।
কয়েক মুহূর্ত কী-একটা ভাবলেন প্রফেসর রাউখ, তারপর দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন, অচিন্তনীয় শক্তির পার্থক্য তোমাদের সাথে আমাদের, সেই শক্তিকে আটকে রেখে তোমরা আমার সাথে যোগাযোগ করতে পার? আমার সাথে কথা বলতে পার?
পারি।
কী আশ্চর্য! তার মানে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে তোমরা আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে আছ। অনেক অনেক এগিয়ে আছ।
আছি।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইলেন প্রফেসর রাউখ। তারপর হঠাৎ তার এক আশ্চর্য সম্ভাবনার কথা মনে হল। একটু দ্বিধা করে প্রকাশ করে ফেলেন সেটা, তোমরা আমার উপর অনেক দিন থেকে জর রাখছ?
রেখেছি। সেজন্যে আমরা দুঃখিত। আমরা ক্ষমা চাইছি।
তোমরা জানতে আমি এই সমস্যার সমাধান করতে যাচ্ছি?
জানতাম। আমাকে ইচ্ছা করলে তোমরা থামাতে পারতে?
পারতাম।
প্রফেসর একটু দ্বিধান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে মেরে ফেলতে পারতে?
পারতাম প্রফেসর রাউখ।
তাহলে—তা হলে আগেই কেন তোমরা আমাকে শেষ করে দিলে না?
আপনি স্বৈরাচারী শাসক নন প্রফেসর রাউখ, আপনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ। আপনাকে হত্যা করার অধিকার আমাদের নেই।
কিন্তু আমি যে-সমস্যাটা সমাধান করেছি, সেটা না করতে পারলে কেউ তোমাদের জগতের কথা জানতে পারত না। আমাকে থামিয়ে দিলে তোমাদের অস্তিত্বের নিশ্চয়তা থাকত।
কিন্তু আপনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ, আপনার গণিত সাধনায় আমরা কী ভাবে বাধা দিই? আপনার আনন্দে তো আমরা হস্তক্ষেপ করতে পারি না।
কিন্তু আমি যেটা সমাধান করেছি, সেটার জন্য তোমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারত।
ছায়ামূর্তি গভীর আত্মবিশ্বাসে মাথা নাড়ে, না, পারত না। আমরা আপনাকে জানি। আমরা জানি, আপনি আপনার গবেষণালব্ধ জ্ঞান কখনো ধ্বংসের জন্যে ব্যবহার করবেন না।
প্রফেসর রাউখ একটু অস্থির হয়ে বললেন, কিন্তু সেটা তো আমার হাতে নেই, সেটা তো জানাজানি হয়ে গেছে।
আপনার সমাধানটি কারো হাতে নেই, আপনি নিজের হাতে সেটি নষ্ট করেছেন। সমাধানটি ছাড়া এই তথ্যটির কোনো মূল্য নেই। এই তথ্যটি আরেকটি কাল্পনিক সূত্র। আপনি ছাড়া আর কেউ সেই সমাধানটি করতে পারবে না।
কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে, আমি যদি সেই সমাধানটি না করে দিই, আমার মস্তিষ্ক নিয়ে নেয়া হবে, আমাকে ভয় দেখিয়েছে রিবেনী। রিবেনীর অসাধ্য কিছু নেই–হঠাৎ প্রফেসর রাউখ থেমে গেলেন, বিষণ্ণ চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে বুঝে গেলেন অনিশ্চিত জগতের অধিবাসীরা কী চাইছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে প্রফেসর রাউখ খুব ধীরে ধীরে বললেন, আমি বুঝতে পেরেছি, তোমরা কেন আমার কাছে এসেছ।
আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
প্রফেসর রাউখ একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমাদের দুঃখিত হবার কিছু নেই।
আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না প্রফেসর রাউখ।
আমি বুঝতে পারছি।
আপনার কথা আমরা আজীবন মনে রাখব। আমাদের জগৎ আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনার মতো মানুষ এই জগৎকে সুন্দর করে রেখেছে প্রফেসর রাউখ।
প্রফেসর রাউখ কিছু বললেন না। চতুষ্কোণের ভিতর থেকে ছায়ামূর্তি বলল, আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই।
আমাকে কী করতে হবে বল।
আপনাকে কিছু করতে হবে না। আপনি চুপচাপ শুয়ে থাকুন।
প্রফেসর রাউখ বিছানায় শুয়ে চাদরটি নিজের শরীরে টেনে দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। আকাশে চাঁদ উঠেছে, তার নরম জ্যোৎস্না কোমল হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কী অপূর্ব দৃশ্য, কখনো ভালো করে দেখেন নি! শেষ মুহূর্তে এই অস্বাভাবিক সৌন্দর্য দেখে হঠাৎ পৃথিবীর জন্যে গাঢ় বিষাদে তাঁর মন ভরে উঠছে।
চতুষ্কোণ নীলাভ জানালা থেকে তীব্র এক ঝলক আলো বের হয়ে আসে প্রফেসর রাউখের দিকে।
রাষ্ট্রপতি রিবেনী হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে বসেন। আশ্চর্য একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছে তাঁর। কারা যেন তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। বিশ্বজগতের প্রতি ক্ষমতার অপব্যবহারের জনা। কী আশ্চর্য স্বপ্ন।
রিবেনী চুপ করে বসে থাকেন, তাঁর হঠাৎ করে মনে হয় কেউ একজন তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকান রাষ্ট্রপতি রিবেনী। কেউ কোথাও নেই, কিন্তু কী বাস্তব একটা অনুভূতি।
অকারণে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল তাঁর।
০৬. স্বপ্ন
ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে বসেন জুলিয়ান। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। হাতড়ে হাতড়ে মাথার কাছে রাখা টেবিল থেকে পানির গ্লাসটি তুলে ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে পুরোটা শেষ করে দেন। ধকধক করে হৃৎপিণ্ড শব্দ করছে বুকের ভিতর, অনেকক্ষণ লাগে নিজেকে শান্ত করতে। কী আশ্চর্য একটা স্বপ্ন দেখেছেন তিনি!