রাষ্ট্রপতি রিবেনী হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমার কাছে খবর এসেছে, আপনি নাকি একটি অস্বাভাবিক আবিষ্কার করেছেন। শুনে খুশি হবেন, আপনার কাজ শেষ করার জন্য এই মুহূর্তে সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদদের নিয়ে একটা ইন্সটিটিউট খোলা হচ্ছে। আপনার নামে সেই ইন্সটিটিউটটি উৎসর্গ করা হবে।
একটি দেশের রাষ্ট্রপতির সাথে কী ভাবে কথা বলতে হয় প্রফেসর রাউখের জানা নেই। তাই বাধা দেয়ার প্রবল ইচ্ছে হওয়া সত্ত্বেও তিনি কাঠ হয়ে বসে রইলেন।
রাষ্ট্রপ্রতি রিবেনী মুখের ধূর্ত হাসিটি বিস্তৃত করে বললেন, আপনার কাজটুকু শেষ করুন। আপনার কী লাগবে আমাদের জানান। যত বড় কম্পিউটার চান, যতজন গণিতবিদ চান, শুধু মুখ ফুটে বলবেন।
প্রফেসর রাউখ শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে বললেন, আমার কাজ তো কিছু বাকি নেই, যে-জায়গাটাতে আটকে ছিলাম, গতরাতে শেষ হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি রিবেনীর চোখ এক মুহূর্তের জন্যে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, কিন্তু সেটা এক মুহূর্তের জন্যেই। মুখে জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন, না, আপনার কাজ শেষ হয় নি। আপনার এখনো দুটি জিনিস বের করতে হবে। এক, আমাদের জগৎটি নিশ্চিত না অনিশ্চিত। দুই, নিশ্চিত এবং অনিশ্চিত জগতের মাঝে যোগাযোগ কেমন করে করা যাবে।
কিন্তু সেটা তো ভয়ানক বিপজ্জনক। ভয়ানক–
রিবেনী ধূর্ত চোখে তাকিয়ে বললেন, সেটাই তো সবচেয়ে বড় কথা। আমরা যদি নিশ্চিত জগতের অধিবাসী হই, তা হলে অনিশ্চিত জগৎকে আমরা হাতের মুঠোয় রাখব। যখন খুশি আমরা তাদের ধ্বংস করে দিতে পারব, তখন তাদের কাছে আমরা যা খুশি তাই দাবি করতে পারব। চিন্তা করতে পারেন, একটি পুরো জগৎ থাকবে আমাদের হাতের মুঠোয়। আমার হাতের আঁঠোয়।
প্রফেসর রাউখ অবাক হয়ে দেখলেন, ব্যাপারটা কল্পনা করে রাষ্ট্রপতি রিবেনীর মুখে একটা নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠছে। বিষাক্ত সরীসৃপ দেখে যেরকম একটা ভয় হয়, হঠাৎ সেরকম একটা ভয় অনুভব করলেন প্রফেসর রাউখ। প্রায় মরিয়া হয়ে বললেন, কিন্তু আমরা যদি অনিশ্চিত জগতের অধিবাসী হই?
সেটা আপনাকে বের করতে হবে প্রফেসর রাউখা অনিশ্চিত জগৎ হলেই যে ব্যাপারটা অন্যরকম হবে, সেটা কেন ভাবছেন? তখন আমরা সারা পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসব, কারণ ইচ্ছে করলে তখন আমরা এই পুরো জগৎ ধ্বংস করে দিতে পারব, কী প্রচণ্ড ক্ষমতা ভেবে দেখেছেন?
রাষ্ট্রপতি রিবেনী প্রফেসর রাউখের চোখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন, কিন্তু সবার আগে আমাদের জানা দরকার আমরা কি নিশ্চিত জগতের অধিবাসী, নাকি অনিশ্চিত জগতের অধিবাসী। আর জানা দরকার, কেমন করে এই দুই জগতের যোগাযোগ করা যায়।
রাষ্ট্রপতি রিবেনী মুখের হাসিকে বিস্তৃত করে বললেন, আপনাকে এক সপ্তাহ সময় দেয়া হল।
প্রথমবার প্রফেসর রাউখ অনুভব করলেন, অসহ্য একটা ক্রোধ ধীরে ধীরে তাঁর শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে, দীর্ঘদিন থেকে তাঁর এই অনুভূতিটির সাথে পরিচয় নেই। অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বললেন, যদি এক সপ্তাহে আমি সেটা বের না করি?
না শোনার ভান করলেন রাষ্ট্রপতি রিবেনী। মাথা নেড়ে বললেন, আপনি বড় গণিতবিদ, এক সপ্তাহে সহজেই বের করে ফেলবেন আপনি, তা ছাড়া আপনাকে সাহায্য করবে অসংখ্য প্রথম শ্রেণীর গণিতবিদ, অসংখ্য শক্তিশালী কম্পিউটার।
কিন্তু আমি যদি এটা করতে অস্বীকার করি?
প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপতি রিবেনীর মুখের মাংসপেশী শক্ত হয়ে যায়, আস্তে আস্তে বললেন, আপনি অস্বীকার করবেন না প্রফেসর রাউখ। আমার অনুরোেধ রাখতে কেউ অস্বীকার করে না—এখনো করে নি।
কিন্তু–
রিবেনী বাধা দিয়ে বললেন, তবু যদি আপনি অস্বীকার করেন, তা হলে আপনার মস্তিটা নিয়ে ক্রুগো কম্পিউটারের সাথে জুড়ে দেব। আমাদের যা বের করার দরকার, সেটা খুব সহজেই বের করা যায় প্রফেসর রাউখ, আপনাকে আর কষ্ট করতে হয় না তা হলে।
অনেক কষ্ট করেও প্রফেসর রাউখ তাঁর আতটুকু লুকাতে পারলেন না। রাষ্ট্রপতি রিবেনী প্রফেসর রাউখের রক্তশূন্য মুখের দিকে তাকিয়ে অমায়িকভাবে হাসলেন। বললেন, আপনার মস্তিষ্ক এভাবে আমি নিতে চাই না, নেহায়েত আপনি যদি জোর করেন, তা হলে ভিন্ন কথা।
ঠিক এ-সময়ে সামরিক বাহিনীর দুজন উচ্চপদস্থ লোক এসে রাষ্ট্রপতি রিবেনীর কানে ফিসফিস করে কী-একটা বলল, সাথে সাথে রিবেনী উঠে দাঁড়ালেন, প্রফেসর রাউখকে কোনো সম্ভাষণ না জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। পিছু পিছু অন্য সবাই। প্রফেসর রাউখ শূন্য ঘরে একা একা বসে রইলেন। তাঁর সমস্ত মুখ তেতো বিস্বাদ।
প্রফেসর রাউখ ঘরে নিজের বিছানায় দুই পা তুলে চুপচাপ বসে রয়েছেন। কিছুক্ষণ আগে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের লোকজন এসে তাঁর সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়ে গেছে। সরকারি মহল থেকে তাদের উপর নির্দেশ দেয়া হয়েছে, প্রায় অপরিচিত এই বৃদ্ধ লোকটিকে রাতারাতি মহামানবের পর্যায়ে তুলে নিতে হবে। প্রফেসর রাউখের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো মূল্য নেই, তাঁর কলের পুতুলের মতো অন্যের নির্দেশ মেনে নেয়া ছাড়া কিছু করার ছিল না। তাঁর চোখের সামনে সংবাদপত্রের লোকেরা তাঁর সাদামাঠা জীবনের ওপর রং চড়িয়ে তাঁকে একটা অতিমানবিক আকর্ষণীয় ব্যক্তিতে পরিণত করে ফেলল।
রাত গভীর হয়ে এসেছে। প্রফেসর রাউখের চোখে ঘুম নেই। দু হাতে মাথা চেপে ধরে তিনি বিছানায় বসে অনেকটা আপন মনে বললেন, আমার বেঁচে থাকার আর কোনো অর্থ নেই। আমার সব শেষ হয়ে গেল। সব শেষ–