প্রফেসর রাউখ কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখেন, আজীবন গণিতের সাধনা করে এসেছেন, যুক্তিতর্ক ছাড়া কিছু বিশ্বাস করেন না। নিজেকে বোঝালেন, আমি ভুল দেখছি, সারা দিন পরিশ্রম করে আমার রক্তচাপ বেড়ে গেছে, তাই চোখে বিভ্রম দেখছি। বিশ্রাম নিলে সেরে যাবে। আমি এখন চোখ বন্ধ করব, একটু পর যখন চোখ খুলব, তখন দেখব কোথাও কিছু নেই।
প্রফেসর রাউখ চোখ বন্ধ করে কয়েকটি দীর্ঘনিঃশ্বাস নিলেন, তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। চোখ খুলে দেখলেন নীলাত চতুষ্কোণ অংশটুকু এখনো আছে, চোখ দুটি এখনো একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু তাই নয়, তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দুটিতে এবার পলক পড়ল, প্রফেসর রাউখ নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখলেন, নীলাভ অংশটুকু ধীরে ধীরে আরো বড় হয়ে উঠছে, চোখ দুটির সাথে সাথে আস্তে আস্তে মুখের আরো খানিকটা দেখা যাচ্ছে—একজন বিষণ্ণ মানুষের চেহারা। করুণ চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।
প্রফেসর রাউখ বিছানায় উঠে বসেন, সাথে সাথে নীলাভ চতুষ্কোণের চোখ দুটিতে ভীতি ফুটে ওঠে। তাঁর কিছু একটা বলার চেষ্টা করে–তিনি বুঝতে পারেন না সেটি কি। প্রফেসর রাউখ বিছানা থেকে নেমে আসেন, সাথে সাথে চোখ দুটি আতঙ্কে স্থির হয়ে যায়, যন্ত্রণাকাতর একটি মুখ আবার তাঁকে কিছু-একটা বলতে চেষ্টা করে। প্রফেসর রাউখ এক মুহূর্ত দ্বিধা করে এক এগিয়ে যান, সাথে সাথে পুরো নীলাভ অংশটুকু দপ করে নিভে গেল।
প্রফেসর রাউখ বাতি জ্বালালেন, যেখানে চোখ দুটি ছিল সে-জায়গাটি খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। কোথাও কিছু নেই—তীর কেন জানি একটু ভয়-ভয় করতে থাকে। কেন এরকম অস্বাভাবিক জিনিস তিনি দেখলেন? প্রফেসর রাউখ ঘর থেকে বের হয়ে ডাকলেন, টনিটি।
ট্রিনিটি কোনো সাড়া দিল না, তখন তাঁর মনে পড়ল, খরচ বাঁচানোর জন্য আজকাল রাতে তাকে সুইচ বন্ধ করে রাখা হয়। তাকে জাগাবেন কী না কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বাইরে এসে বসলেন। পুরো ব্যাপারটা আবার চেষ্টা করলেন আবার। যেদিন থেকে গাণিতিক সমস্যাটার সঠিক সমাধানটি তাঁর মাথায় এসেছে, সেদিন থেকে তাঁর মনে হচ্ছে কেউ-একজল তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগে দেখলেন, সত্যি কেউ-একজন তীর দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যি দেখেছেন তিনি, নাকি চোখের বিভ্রম; সত্যি তো হতে পারে না, কিন্তু চোখের বিভ্রম কেন হবে? বয়স হয়েছে তাঁর, কিন্তু তাঁর মস্তিষ্কে তো এখনো কৈশোরের সজীবতা।
বৃদ্ধ প্রফেসর রাউখ বসে বসে ভোরের আলো ফুটে উঠতে দেখলেন, অকারণে তার মন খারাপ হয়ে রইল।
প্রাতঃরাশ করার সময় ট্রিনিটি প্রফেসর রাউখকে জানাল যে, কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান আকাদেমি থেকে তাঁকে নেয়ার জন্যে গাড়ি পাঠানো হয়েছে। এক ঘণ্টার ভিতর তাঁকে যেতে হবে। শুনে প্রফেসর রাউখ একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন, তাঁর সাথে বিজ্ঞান আকাদেমির কোনো যোগাযোগ নেই প্রায় দুই দশক।
প্রফেসর রাউখের হতচকিত ভাব দেখে ট্রিনিটি বলল, গতকাল আপনি যে সমস্যাটি সমাধান করেছেন, সম্ভবত সেটি বিজ্ঞান আকাদেমিকে অভিভূত করেছে।
প্রফেসর রাউখ চিন্তিত মুখে বললেন, তুমি ওদের জানিয়ে দিয়েছ?
না, আমি বিজ্ঞান আকাদেমিকে জানাই নি, কিন্তু গণিত জার্নালে একটা ছোট সারাংশ পাঠিয়েছি। সেটা তো আমি সব সময়েই পাঠাঁই। আপনি তো তাই বলে রেখেছেন।
হ্যাঁ, প্রফেসর রাউখ মাথা নাড়লেন, আমার ভুল হয়েছে। এই ব্যাপারটা আরো কিছুদিন গোপন রাখা উচিত ছিল, তোমাকে আমার বলে দেয়া উচিত ছিল।
আমি দুঃখিত প্রফেসর রাউখ। ট্রিনিটি তার গলার স্বরে শঙ্কা ফুটিয়ে বলল, আমি খুবই দুঃখিত। আপনার কি কোন সমস্যা হবে?
জানি না। আমি বিজ্ঞান আকাদেমিকে পছন্দ করি না। তারা সবসময় জোর করার চেষ্টা করে। আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পছন্দ করি।
ট্রিনিটি ক্ষুন্ন স্বরে বলল, আমি দুঃখিত প্রফেসর রাউখ।
তোমার দুঃখিত হবার কোনো কারণ নেই ট্রিনিটি। প্রফেসর রাউখ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, গতকাল আমি যেসব কাজ করেছি, সেগুলো পুড়িয়ে ফেলতে পারবে?
সর্বনাশ! কী বলছেন! এত দিনের কাজ
ভয় পেয়ো না, প্রফেসর রাউখ মাথায় টোকা দিয়ে বললেন, সব এখানে রয়ে গেছে। যখন প্রয়োজন হবে, কাগজে আয় বের করে নিতে এবারে কোনো সময় লাগবে না।
সাদা একটা হলঘরে বসে আছেন প্রফেসর রাউখ। যদিও বিজ্ঞান আকাদেমির গাড়িতে চেপে তিনি এসেছেন, তাঁকে কিন্তু বিজ্ঞান আকাদেমির ভবনে না এনে সরকারি একটা ভবনে আনা হয়েছে। ভবনটি অত্যন্ত সুরক্ষিত, এখানে নানা ধরনের প্রহরা, ব্যাপারটি দেখে তাঁর মনে কেমন জানি একটা খটকা লাগতে থাকে।
আসবাবপত্রহীন শূন্য ঘরটিতে দীর্ঘ সময় একা একা বসে থাকার পর হঠাৎ করে কয়েকজন লোক প্রবেশ করে, কাউকেই তিনি চেনেন না। একজনকে মনে হল আগে কোথায় জানি দেখেছেন। কিন্তু কোথায় দেখেছেন ঠিক মনে করতে পারলেন না।
লোকগুলো তাঁকে ঘিরে বসে পড়ে। চেনা চেনা লোকটি খানিকক্ষণ একদৃষ্টে তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে মুখে একটা ধূর্ত হাসি ফুটিয়ে বলল, আপনি আমাকে চিনতে
না। মনে হচ্ছে কোথায় দেখেছি, কিন্তু–
ভারি আশ্চর্য। আমি এদেশের রাষ্ট্রপতি রিবেনী।
প্রফেসর রাউখ চমকে উঠে সোজা হয়ে বসলেন। এই ভণ্ড প্রতারক লোকটির অসংখ্য নিষ্ঠুরতার গল্প প্রচলিত রয়েছে। ঢোক গিলে শুকননা গলায় বললেন, আমি দুঃখিত। আমি–