বল।
আপনি সত্যি তা হলে সমাধান করেছেন?
হ্যাঁ ট্রিনিটি।
আমার অভিনন্দন প্রফেসর রাউখ।
অনেক ধন্যবাদ।
আমি জানতাম আপনি এটা সমাধান করতে পারবেন।
কেমন করে জানতে?
কারণ আপনি হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ।
প্রফেসর রাউখ শব্দ করে হাসলেন। ট্রিনিটি বলল, এটি করতে আপনার সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে।
জানি।
সমস্যাটি কি সত্যিই এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
যে-জিনিস আমরা জানি না সেটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না, সে হিসেবে এটার কোনো গুরুত্ব ছিল না, কিন্তু এখন এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
সত্যি?
হ্যাঁ।
আপনি নূতন কিছু শিখলেন প্রফেসর রাউখ?
শিখেছি।
কী?
বললে তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না।
করব, আপনি বলুন, আমি আপনার সব কথা বিশ্বাস করি।
শোন তা হলে, না বুঝলে প্রশ্ন করবে।
করব।
প্রফেসর রাউখ ট্রিনিটিকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, আমাদের পরিচিত জগৎ হচ্ছে ত্রিমাত্রিক জগৎ, সময়টাকে চতুর্থ মাত্রা হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু সত্যিই কি আমাদের জগৎ চার মাত্রার? এমন কি হতে পারে, যে, জগৎটি আটমাত্রার এবং আমরা শুধুমাত্র চারটি মাত্রা দেখছি এবং বাকি চারটি মাত্রা দেখছি না? ঠিক সেরকম আরেকটি জগৎ রয়েছে, যেখানকার অধিবাসীরা শুধু তাদের চারটি মাত্রা দেখছে এবং আমাদের চারটি মাত্রা দেখছে না? তা হলে একই সাথে থাকবে দুটি জগৎ, একটি আমরা দেখতে পাব, আরেকটি পাব না।
প্রফেসর রাউখ অন্যমনস্কভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ সবই ছিল কল্পনার ব্যাপার। সেটার বাস্তব সম্ভাবনা প্রমাণ করা যায় শুধুমাত্র অঙ্ক কষে। আমি অনেক দিন থেকে এর ওপরে কাজ করছিলাম, আজ আমি সেটার সমাধান বের করেছি। কী দেখেছি জান?
কী?
দেখেছি, আমাদের জগতের বাইরে আরেকটি চতুর্মাত্রিক জগৎ রয়েছে। সেই জগৎ একই সাথে আমাদের পাশাপাশি বেঁচে রয়েছে। সম্ভবত সময়ের মাত্রা দুটি জগতেই এক, সে-অংশটুকু এখনো বের করা হয় নি।
ট্রিনিটি জিজ্ঞেস করল, সেখানে গ্রহ-নক্ষত্র আছে। সেখানে প্রাণের বিকাশ হয়েছে?
এসব হচ্ছে খুঁটিনাটি ব্যাপার। কারো পক্ষে বলা খুব কঠিন, কিন্তু তা খুবই সাব।
পৃথিবীর মানুষ সেই জগতের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে?
প্রফেসর রাউখের মুখ হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে ওঠে। মাথা নেড়ে বললেন, মনে হয় পারবে না। আমার হিসেব যদি ভুল না হয়, তা হলে সেটার চেষ্টা করা হবে খুব ভয়ানক বিপদের কাজ।
কেন?
কারণটি খুব সহজ। আমাদের জগৎ আর সেই জগতের মাঝে শক্তির একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। আমরা সেটা অনুভব করি না, সেই জগতেও সেটা অনুভব করে না। কিন্তু কোনোভাবে যদি দুই জগতের মাঝে একটা যোগাযোগ করে দেয়া যায়, তা হলে যে-জগতের শক্তি বেশি সেখানকার বাড়তি শক্তি পুরো জগৎটাকে ঠেলে অন্য জগতে পাঠিয়ে দেবে।
মানে? ট্রিনিটি বোঝার চেষ্টা করে, আপনি বলছেন, কেউ যদি যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, হঠাৎ করে এখানে সম্পূর্ণ একটা নূতন জগৎ নূতন গ্রহ-নক্ষত্র হাজির হয়ে যেতে পারে?
প্রফেসর রাউখ অল্প মাথা নেড়ে বললেন, অনেকটা সেরকম। কিন্তু সেই ব্যাপারটা হয়তো তত খারাপ নয়, খারাপ হচ্ছে পদ্ধতিটা। যখন পুরো জগৎ একটি ছোট গর্ত দিয়ে বের হয়ে আসতে থাকবে-চিন্তা করতে পার, কী ভয়ানক বিপর্যয়?
তার মানে আপনি বলছেন, যে-জগৎটার শক্তি বেশি, সেটার ভয় বেশি, যে কোনো মুহূর্তে সেটা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে?
কথাটা খানিকটা সত্যি। দুটি জগৎ রয়েছে এখানে, একটা নিশ্চিত জগৎ, আরেকটা অনিশ্চিত জগৎ। যেটা অনিশ্চিত, সেটা যে-কোনো মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
আমাদের জগৎ কোনটি? যেটি নিশ্চিত সেটি, নাকি যেটি অনিশ্চিত, সেটি?
জানি না। সত্যি কথা বলতে কি, সেটা কোনোদিন জানা সম্ভব হবে কি না সেটাও আমি জানি না। কেউ যদি ছোট একটা পরীক্ষা করে বের করতে চায়, অনিশ্চিত জগৎটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
কী ভয়ানক।
হ্যাঁ, ভয়ানক। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক কোনায় একটি ছোট ফুটো করে অন্য জগৎটিকে টেনে নিয়ে এসে ধ্বংস করে দেয়া যায়।
কী ভয়ানক। ট্রিনিটির যান্ত্রিক মস্তিষ্কের পুরো ব্যাপারটি অনুভব করতেও রীতিমতো কষ্ট হয়।
প্রফেসর রাউখ বিছানায় শুয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিতেই আবার সেই আশ্চর্য অনুভূতিটি হল, মনে হল কেউ যেন তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। তিনি অস্বস্তিতে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালেন, কোথাও কেউ নেই, কিন্তু কী বাস্তব অনুভূতি। নিজেকে শান্ত করে কোনোভাবে ঘুমানোর চেষ্টা করেন। মাথার কাছে একটা শিরা দপদপ করছে, সহজে ঘুম আসতে চায় না। কী সাঙ্ঘাতিক একটা জিনিস তিনি বের করেছেন, কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ কেউ নেই, যার কাছে এটা নিয়ে গল্প করতে পারেন। আহা—আজ যদি তাঁর স্ত্রী বেঁচে থাকত। সুদীর্ঘ কুড়ি বছর আগে মৃত স্ত্রীর কথা স্মরণ করে তিনি একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ভোররাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল প্রফেসর রাউখের। কিছু-একটা হয়েছে কোথাও। তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না কি। চোখ মেলে তাকিয়ে থাকেন তিনি, ঘরে নীল একটা আলো, কোথা থেকে আসছে এটি?
চোখ মেলে তাকালেন তিনি, তাঁর সামনে ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় মেঝে থেকে খানিকটা উপরে চতুষ্কোণ একটা জায়গা থেকে হালকা নীল রঙের একটা আলো বের হচ্ছে, ভালো করে না তাকালে দেখা যায় না।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন প্রফেসর রাউখ। খুব ধীরে ধীরে আলোটি উজ্জ্বল হতে থাকে। আস্তে আস্তে সেখানে একজোড়া চোখ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চোখের দৃষ্টি বিষণ্ণ, সেই বিষণ্ণ চোখে একদৃষ্টিতে চোখ দুটি তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে।