রিকি শক্তমুখে বলল, কী নাম তার? কোথায় থাকে?
তাতে তোমার প্রয়োজন কি? তোমাকে যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা হচ্ছে, সেই শিশুটি তোমার থেকে অনেক বেশি প্রতিভাবান ছিল। সে ইচ্ছে করলেই আমাদের সাথে এই সভায় থাকতে পারত। কিন্তু সে থাকে নি। যে-বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্য হয়ে তোমার এত অহঙ্কার, সেই শিশুটির তাতে বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। পৃথিবীতে তোমার থেকে অনেক বড় প্রতিভাবান মানুষ আছে, তবে হ্যাঁ, তোমার মতো অহঙ্কারী, ক্ষমতালোভী উচ্চাকাঙ্ক্ষী সম্ভবত আর কেউ নেই।
রিকি কী-একটা বলতে চাইছিল, রু হাত তুলে তাকে থামিয়ে বললেন, প্রায় তিরিশ বৎসর আগে মহাজাগতিক মেঘ দিয়ে পৃথিবীতে একটা বিপর্যয় নেমে আসার কথা ছিল। আমরা–এই বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যরা, সেই বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিলাম, তুমি সেই ঘটনার কথা জান?
জানি।
পৃথিবীর ইতিহাসে সেই প্রচেষ্টার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কেন থাকবে জান?
জানি।
না, তুমি জান না। তোমার জানার ক্ষমতা নেই। তুমি লোভী এবং স্বার্থপর। দশজন প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানীর একসাথে কাজ করার কি আনন্দ, তুমি কল্পনাও করতে পার না রিকি। পৃথিবীর ইতিহাসে আমাদের প্রচেষ্টার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, কারণ আমরা সবাই একসাথে কাজ করে একটি ভয়ংকর বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিলাম। বিজ্ঞানীদের জীবনে এর থেকে বড় সার্থকতা আর কিছু নেই। ব্যক্তিগত সাফল্যের সাথে এর কোনো তুলনা হয় না। রিকি, তোমাকে আমাদের প্রয়োজন নেই। তুমি কিংবা তোমার মতো একজন বিজ্ঞানী যে-কাজের জন্যে এত অহঙ্কারী হয়ে যাও, তার প্রত্যেকটিই অন্য কয়জন প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানী কয়েক বৎসর চেষ্টা করে বের করে ফেলতে পারে। খুব দুঃখের ব্যাপার, তুমি এই সহজ সত্যটি জান না। তুমি আমাদের কোনো কাজে আস না রিকি, তোমাকে আমাদের প্রয়োজন নেই। তুমি এখন যাও, ভবিষ্যতে আর কখনো এসো না।
রিকি ষড়যন্ত্রীর মতো মুখ করে বলল, যদি না যাই?
যাবে। তুমি নিশ্চয়ই যাবে। তুমি অনেক দিন থেকে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছ।
আপনি কেমন করে জানেন?
আমি জানি। আমি বিজ্ঞান আকাদেমির সভাপতি, তাই আমার কাছে সব খবরাখবর আসে। আমি না চাইলেও আসে। আমি জানি, তুমি পৃথিবীর পুরো রথিনিয়ামটুকু নিজের কাছে এনে জমা করেছ। তুমি এখন পালাবে। কোথায় পালাবে জানি না, কিন্তু তুমি পালাবে।
রিকি মুখে একটা ধূর্ত হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি পালাব?
হ্যাঁ। কারণ তুমি জান, আমরা বিজ্ঞান আকাদেমির নিয়মকানুন পাল্টে ফেলছি। তোমার মতো মানুষের যেন বিচার করা যায় তার ব্যবস্থা করছি।
রিকি এবারে উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠে, আমার বিচার করবেন আপনারা? পৃথিবীর মানুষেরা? কখনো শুনেছেন পৃথিবীর মানুষ ঈশ্বরের বিচার করার চেষ্টা করছে?
রু কোনো কথা না বলে ভুরু কুঁচকে রিকির দিকে তাকিয়ে থাকেন।
রিকি উঠে দাঁড়ায়। হাসতে হাসতে বলে, বেশ, চেষ্টা করে দেখেন। আমি যাচ্ছি—এই নির্বোধদের আসরে আমার জন্যে থাকা আর সম্ভব নয়। বিদায়।
কেউ কোনো কথা বলল না, রিকি দরজা খুলে সভাকক্ষ থেকে বের হয়ে গেল।
রিকি বের হয়ে যাবার পর কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলল না। রু আস্তে আস্তে তাঁর চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন তোমাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ যে তোমরা এই উন্মাদ ব্যক্তিটির সাথে আমার কথোপকথনটি ধৈর্য ধরে শুনলে। তোমরা কেউ যে কোনো কথা বল নি, সে জন্যে আমি সারা জীবন তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।
গণিতবিদ কিরি বললেন, আমরা আপনার ধৈর্য দেখে বিস্মিত হয়েছি মহামান্য রু। একটি ঘুসি দিয়ে তার সবকয়টি দাঁত খুলে না ফেলে কী ভাবে তার সাথে কথা বলা যায় আমার জানা নেই।
অধিবেশন-কক্ষে অনেকে উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠে। রসায়নবিদ নীষা তরল স্বরে বললেন, ভাগ্য ভালো যে তুমি কথা বলার চেষ্টা কর নি, কিরি। এই বয়সী মানুষের মারপিট দেখতে ভালো লাগার কথা নয়।
আবার অধিবেশন-কক্ষে মৃদু হাসির শব্দ শোনা গেল। রু বললেন, চল, কাজ শুরু করা যাক।
নীষা বললেন, মহামান্য রু, আপনি কি খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিতে চান? রিকির সঙ্গে কথা বলা খুব সহজ ব্যাপার নয়।
ঠিকই বলেছ। মিনিট পনেরর জন্যে বিরতি নেয়া যাক। কী বল?
সবাই সানন্দে রাজি হয়ে যায়।
সন্ধেবেলা মহামান্য রু জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন, এমন সময় তাঁর সহকারী মেয়েটি নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায়। রু ঘুরে তার দিকে তাকালেন, কিছু বলবে?
কেন্দ্রীয় তথ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক আপনার সাথে দেখা করতে চান। কি নাকি জরুরি ব্যাপার।
রু অন্যমনস্কভাবে বললেন, আসতে বল।
প্রায় সাথে সাথেই তথ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক এসে হাজির হলেন। বয়স্ক ভদ্রলোক, কপালের দুপাশে চুলে পাক ধরেছে। কমনীয় চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। অত্যন্ত বিনীতভাবে বললেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত আপনাকে এভাবে বিরক্ত করার জন্য।
রু হাসিমুখে বললেন, কে বলেছে তুমি বিরক্ত করছ? তোমার কাছে আমি যে সব মজার খবর পাই, আর কোথায় সেগুলো পাব বল?
আমি খুব দুঃখিত মহামান্য রু, কিন্তু একটা খবর জানানোর জন্যে আমার নিজের আসতে হল।
কি খবর? রিকি কিছু করেছে?
আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন। মহামান্য রিকি তাঁর গোপন গবেষণাগারে কুরু
সেটা কী জিনিস?
কুরু মহাকাশযানের ইঞ্জিন অত্যন্ত মূল্যবান জিনিস। একটি শেষ করতে প্রায় ছয় বছর সময় নেয়। প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী ইঞ্জিন–আন্তঃনক্ষত্র ভ্রমণ ছাড়া অন্য কোনো ব্যবহার নেই। মহামান্য রিকি কী কাজে ব্যবহার করবেন, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই।