যেমন?
যেমন—প্রফেসর রাউখ একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললেন, যেমন কয়দিন থেকে মনে হচ্ছে সব সময় আমার দিকে যেন কেউ তাকিয়ে আছে।
প্রফেসর রাউখের কম্পিউটারটি, যাকে তিনি শখ করে ট্রিনিটি বলে ডাকেন, খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আশ্চর্য।
হ্যাঁ, আশ্চর্য।
ভারি আশ্চর্য।
হ্যাঁ, কিন্তু এটা নিয়ে তোমার ব্যস্ত হবার কোনো কারণ নেই। আমরা মানুষেরা অনেক ধরনের পরস্পরবিরোধী জটিল জিনিস নিয়ে বেঁচে থাকি।
তা ঠিক।
হ্যাঁ, ব্যাপারটা আসলে তত খারাপ নয়—তুমি যত খারাপ মনে কর তত খারাপ নয়। যাই হোক, নতুন কোনো খবর আছে?
ট্রিনিটি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তেমন কিছু নয়।
প্রফেসর রাউখ হাসার চেষ্টা করে বললেন, তার মানে খারাপ খবর। কী হয়েছে বলে ফেল।
আপনার মাসিক ভাতা কমিয়ে অর্ধেক করে দেয়া হয়েছে।
প্রফেসর রাউখ ঘোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি প্রথম সারির গণিতবিদ, তিনি চাইলে তাঁর নামে পৃথিবীতে দুটি ইন্সটিটিউট থাকত, প্রতিপ্রকর্ষ বলের উপর লেখা চমকপ্রদ সমীকরণটি তাঁর চিন্তাপ্রসূত, তাঁর সহকর্মী সেটিকে নিজের বলে ঘোষণা করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। অথচ তিনি অর্থাভাবে শহরের পুরাতন ঘিঞ্জি এলাকায় ছোট একটি ঘর ভাড়া করে দুস্থ শ্রমিকদের মতো কৌটার খাবার খেয়ে বেঁচে থাকেন। তাঁর সেরকম কোনো বন্ধু নেই, স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে নিঃসঙ্গ। ট্রিনিটির সাহচর্যের বাইরে তাঁর কোনো জগৎ নেই। তাঁর প্রয়োজন অতি অল্প, অথচ সেখানেও আবার হাত বসানো হল।
প্রফেসর রাউখ।
বল।
আপনি গ্যালাক্টিক হাইপারডাইরে উপর কাজটা করতে রাজি হয়ে যান।
প্রফেসর রাউখ মাথা নেড়ে বললেন, তা হয় না ট্রিনিটি। নিজের শখের কাজ করি বলে মনে হয় বেঁচে থাকা কত আনন্দের। যদি যুদ্ধ-কৌশলের উপর কাজ করি, তাহলে কি কখনো মনে হবে বেঁচে থাকা আনন্দের?
কিন্তু অন্য অনেকে তো করছে।
করুক। যদি সবাইও করে, তন্তু আমি করব না। জীবন বড় ছোট, সেটা নিয়ে ছেলেখেলা করতে হয় না।
ট্রিনিটি প্রফেসর রাউখের প্রাতঃকালীন খাবারের আয়োজন করতে বের হয়ে গেল। প্রফেসর রাউখ চুপচাপ বিছানায় বসে রইলেন, তাঁর আবার মনে হতে থাকে, কেউ একজন তাঁর দিকে গকিয়ে আছে। তিনি মাথা ঘুরিয়ে তাকান, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চারদিকে দেখেন। কেউ নেই, কিন্তু কী আশ্চর্য, তাঁর তবু মনে হতে থাকে কেউ একজন তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে, বিষণ্ণ দৃষ্টি, কাতর মুখ! কিছু একটা বলতে চায় মিনতি করে। মন খারাপ হয়ে যায় প্রফেসর রাউখের।
একটু বেলা হয়ে এলে প্রফেসর রাউখ কাজ করতে বসেন। অভ্যেসমতো প্রথম ঘণ্টাদুয়েক পড়াশোনা করে নেন। পৃথিবীর যাবতীয় গাণিতিক জার্নালের সারাংশ তাঁর কাছে পাঠানো হয়। এটি খরচসাপেক্ষ ব্যাপার, দুঃসহ অর্থাভাবের মাঝেও তিনি সেটা বন্ধ করেন নি। নূতন নূতন কাজকর্ম কী হচ্ছে, তার উপর চোখ বুলিয়ে নিজের পছন্দসই বিষয়গুলো খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। প্রতিভাবান নূতন কোনো গণিতবিদ বের হয়েছে কী না তিনি লক্ষ রাখেন। কমবয়সী ক্ষ্যাপা গোছের একজন গণিতবিদ হঠাৎ করে গণিতের জগতে একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেবে, এ-ধরনের একটা ছেলেমানুষি চিন্তা প্রায়ই তাঁর মাথায় খেলা করে।
প্রতিজগতের উপর প্রফেসর রাউখ অনেক দিন থেকে কাজ করছেন, সমস্যাটি জটিল এবং প্রতিবার তিনি এক জায়গায় এসে আটকে যাচ্ছেন। যে-ব্যাপারটি নিয়ে সমস্যা, সেটি একটি ছোট গাণিতিক সমস্যা, যার কোনো সমাধান নেই বলে বিশ্বাস করা হয়। এরকম পরিবেশে সাধারণত সমস্যাটা এড়িয়ে একটি সমাধান ধরে নিয়ে কাজ শেষ করা হয়। প্রফেসর রাউখ খাঁটি গণিতবিদ, তিনি কোনো কিছু এড়িয়ে যাওয়া পছন্দ করেন না, তাই গত পনের বছর থেকে তিনি এই ঘোট, গুরুত্বহীন, কিন্তু প্রায় অসম্ভব সমস্যাটি সমাধান করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁর বর্তমান অর্থাভাবের সেটি একটি বড় কারণ।
প্রফেসর রাউখ কাগজ-কলম নিয়ে বসলেন। সমীকরণটি প্রায় কয়েক হাজার বার নানাভাবে লিখেছেন, আজকেও গোটাগোটা হাতে লিখলেন। নিরীহ এই সমীকরণটি যে কত ভয়ংকর জটিল হতে পারে, কে বলবে? প্রফেসর রাউখ সমীকরণটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, হঠাৎ তাঁর মনে হল, আজ হয়তো তার সমাধান বের করে ফেলবেন। কেন এরকম মনে হল তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না।
গত কয়েকদিন থেকে তাঁর মাথায় একটা নূতন জিনিস খেলছে, সেটা আজ ব্যবহার করে দেখবেন। ঠিক কী ভাবে ব্যবহার করবেন এখনো জানেন না। নানারকম সম্ভাবনা রয়েছে, সবগুলো চেষ্টা করে দেখতে একটা জীবন পার হয়ে যেতে পারে তাই খুব ভেবেচিন্তে অগ্রসর হতে হবে। প্রফেসর রাউখ অনামনন্ধভাবে কলমটি ধরে কাগজের উপর ঝুঁকে পড়লেন।
ট্রিনিটি দুপুরবেলা প্রফেসর রাউখকে একগ্লাস দুধ দিয়ে গেল। বিকেলে এসে দেখল, তিনি সেই দুধ স্পর্শও করেন নি। প্রফেসর রাউ ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করতে পারেন না, তাঁর জন্যে সারাদিন অভুক্ত থাকা একটা গুরুতর ব্যাপার। ট্রিনিটি তাঁকে বিরক্ত করল না, কম্পিউটারের স্বল্পবুদ্ধিতে এই লোকটিকে পুরোপুরি অনুভব করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবে আগের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে, এরকম অবস্থায় প্রফেসর রাউখকে একা একা কাজ করতে দিতে হয়।
প্রফেসর রাউখ যখন তাঁর টেবিল ছেড়ে উঠলেন তখন গভীর রাত, প্রচণ্ড ক্ষুধায় তাঁর হাত কাঁপছে। কিন্তু তাঁর মাথা আশ্চর্যরকম হালকা। তিনি বাথরুমে গিয়ে মুখে-চোখে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। ট্রিনিটি হালকা স্বরে ডাকল, প্রফেসর রাউখ।