এক নম্বরের মুখ হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, আমার দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকাল সে। আমি আস্তে আস্তে বললাম, এক নম্বর, তুমি একজন গ্রুনো।
আ-আমি, আমি?
হ্যাঁ, তুমি। তাই তুমি ধরতে পার নি লনার মন খারাপ। একজন মানুষের যদি খুব মন খারাপ হয়, তার সাথে কোনো কথা না বলেও তার কাছাকাছি এসেই সেটা ধরে ফেলা যায়। এটা পরীক্ষিত সত্য। মানুষেরা ধরতে পারে। যন্ত্র পারে না।
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে এক নম্বরের ডান কানের নিচে হাত দিয়ে সুইচটা খুঁজে বের করে তার সার্কিট কেটে দিলাম। দেখতে দেখতে তার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গেল, মুখ দিয়ে অর্থহীন শব্দ করতে করতে এক নম্বর স্থির হয়ে গেল। শরীরে আর কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই।
আমি দু নম্বরকে বললাম, জিনিসটাকে নিচে শুইয়ে রাখ। হঠাৎ করে কারো উপর পড়ে গিয়ে একটা ঝামেলা করবে।
দু নম্বর বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমতা-আমতাভাবে বলল, কেমন করে শোওয়াব।
আমি এগিয়ে গিয়ে বুকে একটা ঘোট ধাক্কা দিয়ে বললাম, এভাবে।
গ্রুনো রবোটটি প্রচণ্ড শব্দ করে মেঝেতে আছড়ে পড়ল। এক নম্বর দীর্ঘদিনের অভ্যাসের কারণে তাকে একবার ধরার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো লাভ হল না। রবোটটি ভালো তৈরি করেছে, এভাবে আছড়ে পড়েও শরীরের কোনো অংশ ভেঙে আলাদা হয়ে গেল না।
আমি টেবিল থেকে আমার ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বাসায় যাবার জন্যে প্রস্তুত হলাম। দুই নম্বর কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আপনাকে যে আমি কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না। বিশ্বাস করেন, নিজের উপর সন্দেহ এসে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আমি কি সত্যিই মানুষ?
অবশ্যি তুমি মানুষ। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগল। আমি আন্তরিকভাবে তার সাথে হাত মিলিয়ে বললাম, এখন তোমার নামটা আমি শুনতে পারি।
মিকালো-আমার নাম শিন মিকালো।
শিন মিকালো, তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগল।
ঠিক এ-সময় লানা দরজায় এসে দাঁড়ায়। মিকালো তাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। উচ্চস্বরে বলল, স্যার বের করে ফেলেছেন গ্রুনোকে।
লানা মেঝেতে পড়ে থাকা গ্রুনোকে একনজর দেখে বলল, কেমন করে বের করলেন?
সহজ, একেবারে সহজ। মিকালো এক হাতের উপর অন্য হাত দিয়ে তালি দিয়ে বলল, একেবারে পানির মতো সহজ। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, লানার মনের অবস্থা কেমন? আমি বললাম, মন খারাপ, গ্রুনো বলল, না
লানা চমকে উঠে আমার দিকে তাকায়। আমি কথোপকথনটি না শোনার ভান করে বললাম, না, তোমাকে একটা কাগজ দিয়েছিলাম খানিকক্ষণ আগে?
লানা শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, কেন? কী হয়েছে?
তোমাকে ভুল কাগজটা দিয়েছি। আমি তাকে আরেকটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললাম, এটা হচ্ছে সেই কাগজ। আগেরটা ফেলে দিও।
আগেরটা ভুল?
হ্যাঁ, ভুল।
এটা ঠিক?
হ্যাঁ, ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে আমার এক ছাত্র কাজ করে, সে মাঝে মাঝে এসব গোপন খবর দিয়ে যায়।
লানা একনজর কাগজটা দেখে বলল, তা হলে আগে যে-কাগজটা দিয়েছিলেন সেটা কি?
ওটা—এটা অন্য জিনিস।
কী জিনিস?
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর কিছু মৌলিক লেখা বই হিসেবে বের করবে, তাদের নাম। আমার এক বন্ধুর ছেলের নামও আছে, জিশান লাও। খুব ভালো ছেলে–
লালার মুখ থেকে গাঢ় বিষাদের ছায়া সরে গিয়ে সেখানে স্বচ্ছ একটা আনন্দের হাসি ঝলমল করে ওঠে। আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল, আপনি ইচ্ছে করে আমাকে ভুল কাগজটা দিয়েছিলেন। ইচ্ছে করে। তাই না?
আমি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললাম, গ্রুনো কোম্পানি কি তাদের রবোটটা নিয়ে তোমাদের সাথে কোনোরকম চুক্তি সই করেছে?
না। কোননারকম চুক্তি সই করে নি?
না। কিছু না।
তা হলে একটা কাজ কর। ওটার কপোট্রনটা খুলে সিস্টেমটা বের করে নাও। সেটা কপি করে তোমাদের বন্ধুবান্ধব পরিচিত মানুষজনকে বিলিয়ে দিও। ঘরে ঘরে সবার কাছে যদি একটা করে সিস্টেম-৯-এর কপি থাকে, তা হলে গ্রুনো কোম্পানিকে পুরো সিরিজটা বাতিল করে দিতে হবে, ভবিষ্যতে আর এ ধরনের মামদোবাজি করবে না।
কপোট্রন কেমন করে খোলে?
স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে কপালের মাঝে জোরে আড়াআড়িভাবে চাপ দাও, খুলে যাবে। দাঁড়াও, আমি খুলে দিচ্ছি–
আমি একটা স্ক্রু-ড্রাইভার বের করে কপালে চাপ দিয়ে রবোটটার মাথাটা খুলে আনলাম।
গ্রুনো রবোটটি মাথা খোলা অবস্থায় ঘোলাটে চোখে বিসদৃশ ভঙ্গিতে মেঝের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে রইল।
০৫. অনিশ্চিত জগৎ
ঘুম থেকে উঠে খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকেন বৃদ্ধ রাউখ। কয়দিন থেকে তাঁর একটা আশ্চর্য অনুভূতি হচ্ছে। সব সময়েই মনে হয় কেউ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। এত বাস্তব অনুভূতি যে রাউখ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক না দেখে পারলেন না।
কী দেখছেন প্রফেসর রাউখ?
প্রফেসর রাউখৈর ছোট কম্পিউটারটি মিষ্টি স্বরে তাঁকে জিজ্ঞেস করল, কয়দিন থেকে দেখছি আপনি হঠাৎ হঠাৎ করে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক দেখছেন। কী দেখছেন?
নাহ্, কিছু না।
বলুন না কী হয়েছে। কম্পিউটারটি অনুযোগের সুরে বলল, আপনি তো আমার কাছে কখনো কিছু গোপন করেন না।
বৃদ্ধ রাউখ মাথা চুলকে বললেন, ব্যাপারটা তোমাকে বোঝাতে পারলে বলতাম, কিন্তু তুমি ঠিক বুঝবে না। জিনিসটা নেহায়েত মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। মানুষ লক্ষ
কোটি বছরের বিবর্তনের ফল, তাদের রক্তে কিছু কিছু আশ্চর্য জিনিস রয়ে গেছে, যার জন্যে মাঝে মাঝে তারা এমন কিছু অনুভব করে, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।