দু নম্বর একটু এগিয়ে এসে বলল, গত সংখ্যা বিজ্ঞান সংবর্তে আপনার লেখাটা পড়ে–
তুমি কি গ্রুনো?
দু নম্বর থতমত খেয়ে গেল। কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, আমি যতদূর জানি—আমি গ্রুনো না। আমার অতীত জীবনের সবকিছু পরিষ্কার মনে আছে, গ্রুনো হলে নিশ্চয়ই মনে থাকত না। খুব ছেলেবেলায় দোলনা থেকে পড়ে গিয়ে একবার হাঁটু কেটে গেল, সেটাও মনে আছে। সত্যি কথা বলতে, কাটা দাগটা এখনো আছে। দেখবেন?
আমি কিছু বলার আগেই এক নম্বর বলল, দেখাও দেখি।
নম্বর প্যান্ট হাঁটুর উপর টেনে তুলে একটা কাটা দাগ দেখাল।
এক নম্বর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কাটা দাগটা খানিকক্ষণ দেখে বলল, জালিয়াতি, পুরো জালিয়াতি। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কেমিক্যাল এচিং।
দু নম্বর গম্ভীর গলায় এক নম্বরকে জিজ্ঞেস করল, তোমার কি শৈশবের কথা মনে আছে?
অবশ্যই মনে আছে।
কত শৈশব?
অনেক শৈশব।
দু নশ্বর মাথা নেড়ে বলল, কিছু আসে-যায় না। আমি কোনোভাবে জানতে পারব তুমি সত্যি কথা বলছ, না মিথ্যা কথা বলছ।
আমি মিথ্যা বলি না।
সেটাও কোনদিন প্রমাণ করা যাবে না। দু নম্বর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝলেন স্যার, আজ সারাটি দিন খুব অপমানের মিঝে কেটেছে। আমাকে দেখলেই বুঝবেন, জীবিকার জন্যে মানুষকে কী না করতে হয়। আমার সম্পর্কে এক চাচার কাজ ছিল একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গলদা চিংড়ি সেজে দাঁড়িয়ে থাকা। কী অপমান।
লানা আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, স্যার, কিছু বুঝতে পারলেন? আমার মনে হয় দু নম্বর, কী বলেন?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, এখনো জানি না।
তা হলে?
তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।
কী কাজ?
আমি গলা নামিয়ে বললাম, তুমি তোমার অফিসে গিয়ে বস। আমি এখান থেকে দুজনকে পাঠাব। তুমি তাদের সাথে হালকা কোনো জিনিস নিয়ে কথা বলবে। হাসির কোনো গল্প। বেশিক্ষণ নয়, ঘড়ি ধরে দুই মিনিট।
ঠিক আছে।
আর শোন, ঘরের বাতিগুলো কমিয়ে দেবে, যেন তোমাকে ভালো করে দেখতে না পারে।
বেশ।
ওদের বসাবে তোমার খুব কাছাকাছি। একটা টেবিলের এপাশে আর ওপাশে।
ঠিক আছে স্যার।
লানা চলে যাচ্ছিল, আমি তাকে ডেকে ফেরালাম। হঠাৎ মনে পড়েছে এরকম ভঙ্গি করে বললাম, তুমি তো রাজনীতি সমাজনীতি এরকম অনেক কাজকর্ম কর, কয়দিন থেকে ভাবছি তোমাকে একটা জিনিস বলব।
কী জিনিস? পরে বলল, আমাকে মনে করিয়ে দিও।
দেব স্যার।
আর এই কাগজটা রাখ, কাউকে দেখাবে না। কয়দিন থেকে তোমাকে দেব ভাবছি, মনে থাকে না।
লানা কাগজটি নিয়ে বের হয়ে প্রায় সাথে সাথে ফিরে এল। আমি জানতাম আসবে, কারণ এখানে যে-ছয়জনের নাম লেখা হচ্ছে, তার একজন হচ্ছে জিশান লাও। শুধু তাই নয়, উপরে লেখা আছে পুলিশের গুপ্তচর। লানা পাংশু মুখে জিজ্ঞেস করল, এখানে কাদের নাম?
আমি গলা নামিয়ে বললাম, তোমরা যারা রাজনীতি কর, তাদের পিছনে সরকার থেকে গুপ্তচর লাগানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার ভান করে এরা তোমাদের ভিতর থেকে খবর বের করার চেষ্টা করবে। পুলিশের টিকটিকি। এদের থেকে সাবধান।
লানার মুখ মুহূর্তে ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে যায়। কিছু-একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে চলে যেতে থাকে। এরকম প্রাণবন্ত একটি মেয়েকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখা খুব কষ্টকর। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।
আমি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে এক নম্বর এবং দু নম্বরকে বললাম, তোমরা দু জন এখন করিডোরের শেষ ঘরটিতে ঝবে। সেখানে লানা তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে। সে তোমাদের সাথে কিছু-একটা কথা বলবে, সেটা শুনে আমার কাছে এস। ঠিক আছে?
দু জনে মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
যাও।
দুজনেই বের হয়ে গেল। পাঁচ মিনিটের মাঝেই দু জনে ফিরে এল। দুজনেরই হাসি-হাসি মুখ—এক নম্বরের মনে হল একটু বেশি হাসিমুখ।
জিজ্ঞেস করলাম, লানার সাথে কথা হল?
হ্যাঁ, হয়েছে। এক নম্বর দাঁত বের করে হেসে বলল, মেয়েটার যাকে বলে একেবারে তীক্ষ্ণ রসিকতাবোধ। এমন হাসির একটা গল্প বলেছে, কী বলব। একজন লোক টুথব্রাশ বিক্রি করে। দেখা গেল তার মতো আর কেউ
দু নম্বর বাধা দিয়ে বলল, আমার মনে হয় না স্যার এখন তোমার মুখ থেকে গল্পটা শুনতে চাইছেন।
না, আমি মানে—এক নম্বর আমতা-আমতা করে থেমে গেল। আমি টেবিলের উপর থেকে দরকারি কিছু কাগজপত্র আমার হাতব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বললাম, লানার মনের অবস্থা কেমন দেখলে?
মনের অবস্থা?
হ্যাঁ, মনের অবস্থা কেমন?
এক নম্বর একটু অবাক হয়ে বলল, মনের অবস্থা আবার কেমন হবে? ভালো। এত হাসির একটা গল্প বলল—এক নম্বর আবার দাঁত বের করে হাসা শুরু করে।
দু নম্বর মাথা নেড়ে বলল, সত্যি কথা বলতে কি স্যার, আপনি যখন জিজ্ঞেস করলেন, আমি বলি, আমার কেন জানি মনে হল মেয়েটার মন খারাপ।
মন খারাপ? এক নম্বর অবাক হয়ে বলল, মন খারাপ হবে কেন? কী দেখে তোমার মনে হল মন খারাপ?
দু নম্বর মাথা চুলকে বলল, ঠিক জানি না, কিন্তু মনে হল—
এক নম্বর মাথা চুলকে বলল, অন্ধকারে বসেছিল, ভালো করে দেখা পর্যন্ত যাচ্ছিল না, আর তোমার মনে হল মন খারাপ?
দু নম্বর একটু থতমত খেয়ে বলল, ইয়ে, ঠিক জানি না কেন মনে হল। আমি অবশ্যি একেবারে নিশ্চিত না। হতে পারে ভুল মনে হয়েছে।
আমি দু নম্বরের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, না, তোমার ভুল মনে হয় নি, তুমি ঠিকই ধরেছ। লানার আসলেই মন খারাপ।