সমস্যার কথা, কী বল?
লানা আমার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল আমি ঠাট্টা করছি কি না। একটু পর প্রায় মরিয়া হয়ে বলল, আপনি বের করে দেবেন?
আমি?
লানা মাথা নাড়ে, আমরা সারা দিন চেষ্টা করেছি।
পার নি?
না। লজ্জায় মেয়েটির চোখে প্রায় পানি এসে যায়। কাতর গলায় বলল, যতভাবে সব চেষ্টা করেছি, মানুষের যতরকম অনুভূতি আছে সবগুলো চেষ্টা করে দেখেছি, কোনো লাভ হয় নি। লানা আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, আপনি বের করে দেবেন?
আমার মেয়েটির জন্যে খুব মায়া হল। বাইরে সেটা প্রকাশ না করে উদাস ভঙ্গিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললাম, যদি সত্যি বের করতে না পার, তাহলে তো স্বীকার করতেই হবে গ্রুনো রবোট সত্যিই মানুষের মতো।
সেটা তো স্বীকার করছিই। মানুষের মতো আর মানুষ দুটি তো এক জিনিস নয়। মানুষের সত্যিকার অনুভূতি থাকবে না, কিন্তু মানুষের বিচার করবে—সেটা তো হতে পারে না। দেবেন বের করে?
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম, বিকেল হয়ে আসছে, সন্ধেবেলা একটা কনসার্টে যাবার কথা, হাতে খুব বেশি সময় নেই। কিন্তু মেয়েটি এত আশা করে এসেছে, তাকে তো নিরাশ করা যায় না। লানার দিকে তাকিয়ে বললাম, ঠিক আছে, ওদের নিয়ে এসে বাইরে অপেক্ষা কর। আমি না ডাকা পর্যন্ত ভিতরে আসবে না।
লানার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আমি নিশ্চিত, অন্য কেউ হলে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরত। আমার মুখের গাম্ভীর্যটি দেখে সাহস করল না। দীর্ঘদিন চেষ্টা করে এই গাম্ভীর্যটি আয়ত্তে এনেছি, সহজে কেউ কাছাকাছি আসতে সাহস করে না।
লানা বের হয়ে যেতেই আমি আমার সেক্রেটারি ট্রীনাকে ডাকলাম। ট্ৰীনা মধ্যবয়সী হাসিখুশি মহিলা। ভিতরে ঢুকে বলল, কিছু বলবেন স্যার?
তোমার খানিকক্ষণ সময় আছে?
অবশ্যই। সে আমার সামনের খালি চেয়ারটিতে বসে পড়ে বলল, কী করতে হবে?
আমি ষড়যন্ত্রীর মতো গলা নামিয়ে বলল, লানার ছেলে-বন্ধু জিশানকে তুমি চেন?
টীনা বিস্ময়টুকু সযত্নে গোপন ককেবলল, সেরকম চিনি না, সাথে দেখেছি দু একবার।
ওর বাবা আমার বিশেষ বন্ধ ছিল। ছেলেটি যদি বাবার কাছাকাছি হয়, তা হলে খুব হৃদয়বান হওয়ার কথা।
ট্রীনা মাথা নেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি গলার স্বর আরো নামিয়ে বললাম, জিশানের পুরো নাম জিশান লাও। ডাটা বেসে খোঁজ করে দেখ তো, ওর সম্পর্কে কোনো চোখে পড়ার মতো তথ্য পাও কি না। আমার নাম বাবহার করে খোঁজ কর, অনেক রকম খোঁজ পাবে তা হলে।
ট্রীনা কিছুক্ষণের মাঝেই একটা কাগজ নিয়ে ঢুকল, আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, জিশানের উপর অনেক বড় ফাইল আছে, আমি শুধু দরকারি জিনিসটা টুকে এনেছি।
আমি একনজর দেখে বললাম, ঠিক আছে ট্রীনা, তুমি লানাকে বলবে ভিতরে আসতে? তার দুজন সঙ্গীকে নিয়ে।
লানা প্রায় সাথে সাথেই দুজন মানুষকে নিয়ে ঢুকল। কিছু কিছু মানুষের চেহারা দেখে বয়স বোঝা যায় না, এদের দুজনেই সেরকম। পরনে মোটামুটি ভদ্র পোশাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মতো খাপছাড়া নয়। একজন আমার দিকে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমার নাম—
আমি বাধা দিয়ে বললাম, তোমার নাম এক নম্বর।
হ্যাঁ, আপাতত তোমার ঠিক নামটি শুনে কাজ নেই। কারণ তুমি যদি গ্রুনো রবোট হয়ে থাক তাহলে সম্ভবত মিথ্যা একটা নাম বলবে। শুধু শুধু মিথ্যাচার করে লাভ কি? তোমাকে ডাকা যাক এক নম্বর।
এক নম্বরের দুই গাল একটু লাল হয়ে ওঠে। রাগ হয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে উষ্ণ স্বরে বলল, আমি গ্রুনো রবোট নই। আমাকে জোর করে পাঠিয়েছে ওর সাথে। সে দ্বিতীয় লোকটিকে দেখিয়ে বলল, ঐ হচ্ছে গ্রুনো রবোট।
দ্বিতীয় লোকটি এবারে একটু মধুর ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করে বলল, আপনার কথা অনেক শুনেছি আমি। পরিচয় হয়ে খুব ভালো লাগল। অবশ্যি ঠিক পরিচয় হল না, কারণ আপনি তো নিশ্চয়ই আমার নামও শুনতে চাইবেন না।
না। আপাতত তোমার নাম হোক দুই নম্বর।
মানুষকে তার নিজের পরিচয় দিতে না দেয়ার মাঝে খানিকটা অপমানের ব্যাপার আছে।
এক নম্বর ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, তোমার সাথে এসেছি বলে আজ আমার এই অপমান।
আমিও তো একই কথা বলতে পারি।
না, পার না, এক নম্বর চোখ লাল করে বলল, তুমি গ্রুনো।
তুমি এত নিশ্চিত হলে কেমন করে যে আমি গ্রুনো?
কারণ আমি জানি আমি গ্রুনো না, আমি মানুষ।
কেমন করে জান? হতে পারে তুমি মিথ্যা বলছ। কিংবা কে জানে আরো ভয়ংকর জিনিস হতে পারে, তুমি ভাবছ তুমি মানুষ, কিন্তু আসলে তুমি গ্রুনো। তুমি নিজেই জান না যে তুমি গ্রুনো।
এক নম্বরকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেটা কি হতে পারে?
কোনটা?
যে, আমি গ্রুনো কিন্তু আমি জানব না?
না। কারণ তুমি যদি গ্রুনো হয়ে থাক, তা হলে তোমার মাথায় মস্তিষ্কের বদলে রয়েছে একটা কপোট্রন। তোমার বুকের মাঝে আছে একটা পারমাণবিক সেল। তোমার কপোট্রন ক্রমাগত হিসেব করছে সেলের ভোল্টেজ, ক্লক ফ্রিকোয়েন্সি, আর তোমাকে সেটা জানাচ্ছে মিলিসেকেণ্ড পরপর। কাজেই তুমি যদি গ্রুনো হয়ে থাক, তা হলে তুমি মিথ্যাবাদী গ্রুনো।
এক নম্বর উষ্ণ স্বরে বলল, আমি শুনন না, আমি মানুষ।
গ্রুনোকে মানুষের মতো করে তৈরি করা হয়েছে, কাজেই তুমি যদি গ্রুনো হয়ে থাক, তুমি মিথ্যা বলবে না আমি সেরকম আশা করছি না।