আমি চোখ সরিয়ে নিজের কাজে মন দিলাম। সপ্তম মাত্রার একটা সমীকরণ নিয়ে কয়েকদিন থেকে বসে আছি। সমাধানটি মাথায় উঁকি দিয়ে দিয়েও সরে যাচ্ছে, কিছুতেই বাগে আনতে পারছি না। যৌবনে মস্তিষ্কের যে একটা সতেজ ভাব ছিল, সেটা এখন নেই, নিজেই প্রায় সময়ে অনুভব করতে পারি। হাঁটুর উপর মোটা খাতাটি রেখে পেন্সিল দিয়ে সমীকরণটি বড় বড় করে লিখে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। সমাধানটি আবার মাথায় উঁকি দিয়ে যেতে থাকে, আমার সমগ্র একাগ্রতা জটিল সমীকরণটির সেই অস্পষ্ট সমাধানটির পিছু ছুটতে থাকে।
কতক্ষণ মোটামুটি ধ্যানস্থ হয়ে বসে ছিলাম জানি না, লানার গলার স্বরে ঘোর ভাঙল।
স্যার, ভিতরে আসতে পারি?
আমি কিছু বলার আগেই সে ভিতরে ঢুকে এল। বরাবরই তাই করে, আমি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তামগ্ন থাকলে কেউ আমাকে বিরক্ত করার সাহস পায় না, গত সপ্তাহে শহরের মেয়র আমার সাথে দেখা করতে এসে দরজার বাইরে পনের মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন। সে তুলনায় এই মেয়েটি যে দুঃসাহসী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি লানার মুখের দিকে তাকালাম। তার চোখে-মুখে উত্তেজনার ছাপ সবসময়েই থাকে। সতেজ গলায় বলল, সার, আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।
আমি চেষ্টা করে মুখে গাম্ভীর্যটা ধরে রাখলাম, বললাম, আশা করি কাজটা গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
তুমি জান, আমার নিজের কাজ ছাড়াও আমাকে আরো অন্তত দশটা কমিটির জন্যে কাজ করতে হয়।
জানি—লানা মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে বলল, আমার ধারণা, আপনি সেসব কমিটিতে সময় নষ্ট না করলে নিজের কাজ খুব ভালোভাবে করতে পারতেন।
লানাকে দেখার আগে আমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে, কেউ এভাবে আমার সাথে কথা বলতে পারে। কিন্তু না যে-কথাটি বলেছে সেটি সত্যি, আমি নিজে সেটা খুব ভালো করে জানি। আমি মেয়েটির কাছে সেটা প্রকাশ করলাম না, গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললাম, তুমি জান, সেসব কমিটির কোনো-নোেটিতে রাষ্ট্রপতি এবং বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা আছেন?
লানা নিজের চুল খামচে ধরে বলল, আমি বিশ্বাসই করতে রাজি না যে, আপনি ঐসব মানুষকে কোনো গুরুত্ব দেন। ওদের সবগুলোকে পাগলা-গারদে রাখার কথা।
আমার হাসি আটকে রাখতে অত্যন্ত কষ্ট হল। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, তোমার কাজটা কি?
আপনি জানেন, গ্রুনো নামে নতুন রবোট বের হয়েছে?
শুনেছি।
ওদের কপোট্রনে নাকি সিস্টেম-৯ ঢোকানো হয়েছে।
সেটার মানে কি?
আপনি সিস্টেম-৯ কী, জানেন না লানা আমার অজ্ঞতায় খুব অবাক হল এবং সেটা গোপন রাখার কোনো-রকম চেষ্টা করল না। বলল, গত দশ বছর থেকে সিস্টেম ৯-এর উপর কাজ হচ্ছে। এটা হচ্ছে এমন একটা সিস্টেম, যেটার সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য নেই।
কী আছে সেখানে?
কেউ জানে না, অত্যন্ত গোপনীয় জিনিস। এখন সেটাকে গ্রুনো রবোটের কপোট্রনে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
সেটার মানে কি?
লালা উত্তেজিত মুখে বলল, তার মানে গ্রুনো রবোর্টের সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। দেখে, কথা বলে কোনোভাবেই বোঝা যাবে না কোনটা মানুষ, কোনটা রবোট।
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, পৃথিবীতে কি সত্যিকার মানুষের অভাব আছে যে এখন গ্রুনো রবোটকে মানুষ হিসেবে বাজারে ছাড়তে হবে?
লানা আমার কথাটি লুফে নিয়ে বলল, সেটাই তো কথা। বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা কী বলছে শোনেন নি?
কী বলেছে?
কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে দেশের সব বিচারপতিদের অবসর করিয়ে দিয়ে সেখানে গ্রুনো রবোটদের বসানো হবে।
সত্যি?
সত্যি। লানা মুখের উপর থেকে চুলের গোছা সরিয়ে বলল, আজকের কাগজে উঠেছে।
বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা লোকটির সম্ভবত সত্যিই মাথা খারাপ। লানার পরামর্শ শুনে কিছুদিন পাগলাগারদে আটকে রাখলে মনে হয় মন্দ হয় না। আমার সাথে লোকটির মাঝে মাঝে দেখা হয়। বলে দিতে হবে যেন এরকম বেফাঁস কথাবার্তা না বলে। দেশের অর্থনীতির একটা বড় অংশ রবোটশিল্পের উপর নির্ভরশীল, মনে হয় সেই শিল্পকে খুশি রাখার জন্যে এ-ধরনের কথাবার্তা মাঝে মাঝে বলে ফেলতে হয়।
নানা গম্ভীর গলায় বলল, গ্রুনো কোম্পানির সাহস কী পরিমাণ বেড়েছে, আপনি শুনতে চান?
ওদের ফ্যাক্টরি থেকে দুজন মানুষ পাঠিয়েছে আমাদের কাছে, তার মাঝে নাকি একজন হচ্ছে সত্যিকার মানুষ, আরেকজন গ্রুনো রবোট।
কোনটা গ্রুনো রবোট?
জানি না। লানাকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, বলল, কোনটা ওরা বলবে না, আমাদের বের করতে হবে।
কেন?
আমরা গ্রুনো রবোটকে বিচারপতি পদে বসানো নিয়ে একটা প্রতিবাদ সভা করেছিলাম, সেটা শুনে কোম্পানি এই দুজন মানুষ পাঠিয়েছে। ওরা আমাদের কাছে প্রমাণ করতে চায় যে, গ্রুনো রবোট হুবহু মানুষের মতে, কোনো পার্থক্য নেই। ওরা দাবি করেছে যে, আমরা কিছুতেই বের করতে পারব না কোনটা মানুষ, কোনটা গ্রুনো রবোট।
পেরেছ?
লানা ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, না।
বাজিতে হেরে গেলে?
কিন্তু স্যার, আপনি বুঝতে পারছেন আমরা যদি বের করতে না পারি তা হলে কী হবে?
কী হবে?
গ্রুনো রবোট কোম্পানি সব খবরের কাগজ, রেডিও, টেলিভিশনে খবরটা প্রকাশ করে দেবে। বড় বড় করে বিজ্ঞাপন দেবে যে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ চব্বিশ ঘণ্টা চেষ্টা করেও গ্রুনো রবোটের সাথে মানুষের পার্থক্য ধরতে পারে নি। তারপর সত্যি সত্যি বিচারকদের জায়গায় গ্রুনো রবোটকে বসানো হবে।