মাহামান্য লী হাত বাড়িয়ে অ্যালটি তুলে নেন, চোখের কাছে নিয়ে সেটিকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে পাশে বসে থাকা শান সোয়ানের হাতে দেন। একজন একজন করে সবাই অ্যাম্পুলটি দেখেন, কারো মুখে কোনো কথা নেই, জিবান সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, এই প্রাণী আমাদের ব্যবহার করছে জ্ঞান সংগ্রহের জন্যে। আমি নিজেও তাই সন্দেহ করেছিলাম, আজ ভোরে মূল কম্পিউটারও তার গবেষণা শেষ করে আমাকে এটা জানিয়েছে। তোমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কম্পিউটারে আমি তার রিপোর্ট পাঠিয়েছি, ইচ্ছে হলে দেখতে পার। জিবান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমার কথা শেষ, এখন তোমাদের যা ইচ্ছে হয় কর।
সবাই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। মহামান্য লী আস্তে আস্তে বললেন, তার মানে আমাদের এই জ্ঞান-সাধনা–
বাজে কথা! সব ওদের একটা ল্যাবরেটরি পরীক্ষা। আমরা মানুষেরা যে সৃষ্টির পর থেকে শুধু জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করছি, তার কারণ, কেউ একজন আমাদের বলে দিয়েছে, এটা কর। কী লজ্জার কথা। মানুষের আসল ব্যবহার কী, কে জানে।
সবাই একসাথে কথা বলার চেষ্টা করে, নীষের গলা সবচেয়ে উপরে উঠে সবাইকে থামিয়ে দেয়। নীষ বললেন, জিবান আমাকে ব্যাপারটি বলার পর থেকে আমি বের করার চেষ্টা করছিলাম সেই উন্নত প্রাণী মানুষের সাথে কী ভাবে যোগাযোগ রাখে। আপনারা চিন্তা করলে নিজেরাই বের করতে পারবেন, সবচেয়ে সহজ হয়। মানুষের চেহারার একটা-কিছু তৈরি করে মানুষের মাঝে ছেড়ে দিলে। যেহেতু আমাদের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান কাউন্সিল নামে একটা সংগঠন রয়েছে, কাজেই আমার ধারণা, মানুষের চেহারার সেই উন্নত প্রাণীদের গুপ্তচর এই বিজ্ঞান কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে থাকবে।
বিজ্ঞান কাউন্সিলের সদস্যরা ভয়ানক চমকে নীষের মুখের দিকে তাকালেন। মহামানা লী বললেন, তুমি বলতে চাও–
নীষ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমার গোপন সংখ্যা ব্যবহার করে আমি গতরাতে আপনাদের সবার জীবন-ইতিহাস, আপনাদের ব্যক্তিগত দিনলিপি পড়েছি, আমি সেজন্য ক্ষমা চাইছি। আমার ধারণা ছিল আমি সেখান থেকে বের করতে পারব, কারণ আমি ধরে নিয়েছিলাম, যে উন্নত প্রাণীদের গুপ্তচর, সে নিজে সেটি জানে। কিন্তু সেটা সত্যি নয়।
জিন অধৈর্য হয়ে বললেন, তুমি কি শেষ পর্যন্ত বের করতে পেরেছ?
হ্যাঁ।
কে সেই লোক?
আমি।
ঘরের ভিতরে বাজ পড়লেও কেউ বুঝি এত অবাক হত না। কয়েক মুহূর্ত লাগে সবার ব্যাপারটি বুঝতে। জিবান কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তুমি কী ভাবে জান তুমিই সেই লোক? হয়তো তুমি ভুল করেছ, হয়তো
নীষ ম্লান মুখে হাসলেন, আমি নিজেও তাই আশা করছিলাম। কিন্তু আমিই আসলে সেই গুপ্তচর, আমাকে দিয়েই সেই উন্নত প্রাণী পৃথিবীর খোঁজখবর নেয়। বিশ্বাস কর তোমরা, আমি নিজে সেটা জানতাম না। যখন জেনেছি, নিজেকে এত অপরাধী মনে হয়েছে যে আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম।
নীষ নিজের শার্ট খুলে দেখালেন, বুকে গুলির দাগ, রক্ত শুকিয়ে আছে। বললেন, আমি আমার হৃৎপিণ্ডের ভিতর দিয়ে দুটি গুলি পাঠিয়েছি, কিন্তু তবু আমি মারা যাই নি। সেই উন্নত প্রাণী যতক্ষণ না চাইলে আমি মারা যেতে পারব না, আমাকে বুকে গুলি নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। নয় আস্তে আস্তে নিজের চেয়ারে বসলেন, মাথা নিচু করে বললেন, তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও।
আস্তে আস্তে তিনি টেবিলে মুখ ডেকে হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
০৪. গ্রুনো রবোট
দুপুরের পর বড় জানালাগুলো দিয়ে রোদ এসে আমার অফিস-ঘরটি আলোকিত হয়ে যায়। আমি তখন চেয়ারটা টেনে নিয়ে বোদে গিয়ে বসি, বয়স হয়ে যাবার পর এ ধরনের ছোটখাটো উষ্ণতার জন্যে শরীরটা কাঙাল হয়ে থাকে। এখানে বসে জানালা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়াঢাকা প্রাঙ্গণটুকুর পুরোটাই চোখে পড়ে। বসে বসে ছাত্রছাত্রীদের হৈচৈ দেখতে বেশ লাগে। তারুণ্যের একটা আকর্ষণ আছে, আমি সহজে চোখ ফেরাতে পারি না। হৈচৈ চেঁচামেচি দেখে মাঝে মাঝেই আমার নিজের ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়ে যায়, সমস্ত পৃথিবীটা তখন রঙিন মনে হত। একজন মানুষ তার জীবনে যা-কিছু পেতে পারে, আমি সবই পেয়েছি, কিন্তু তবু মনে হয় এর সবকিছুর বিনিময়ে ছাত্রজীবনের একটি উজ্জ্বল অপরাহ্নও যদি কোনোভাবে ফেরত পেতে পারতাম!
জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বড় ঝাউগাছটার নিচে একটা ছোট জটলার মত। মাঝখানে দাঁড়িয়ে লানা হাত-পা নেড়ে কথা বলছে, তাকে ঘিরে বেশ কিছু উত্তেজিত তরুণ-তরুণী। লানা আমার একজন ছাত্রী, সময় পরিভ্রমণের সূত্রের উপর আমার সাথে কাজ করে। বুদ্ধিমতী মেয়ে, রাজনীতি বা সমাজসেবা এই ধরনের আনুষঙ্গিক কার্যকলাপে যদি এত সময় ব্যয় না করত, তা হলে এতদিনে তার ডিগ্রি শেষ হয়ে যাবার কথা ছিল। খুব প্রাণবন্ত মেয়ে, অন্যদের জন্যে কিছু করার জন্যে এত ব্যস্ত থাকতে আগে কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ইদানীং মাঝে মাঝে চশমা-পরা এলোমেলো চুলের এক তরুণের সাথে দেখি। সাহিত্যের ছাত্র, নাম জিশান লাও। ওর বাবাকে খুব ভালো করে চিনি, কারণ ছাত্রজীবনে দুজনে রাত জেগে দীর্ঘ সময় নানারকম অর্থহীন বিষয় নিয়ে তর্ক করেছি। ছেলেটি যদি তার বাবার হৃদয়ের এক-ভগ্নাংশও কোনোভাবে পেয়ে থাকে, তা হলে অত্যন্ত হৃদয়বান একটি ছেলে হবে তাতে সন্দেহ নেই। লালার সাথে সম্ভবত ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, নূতন ভালবাসার মতো মধুর জিনিস পৃথিবীতে কী আছে? লানা এবং জিশানকে একসাথে দেখে আমার নিজের প্রথম যৌবনের কথা মনে পড়ে যায়, যখন মনে হত ভালবাসার মেয়েটির একটি চুলের জন্যে আমি সমস্ত জগৎ লিখে দিতে পারি।