নীষ চিন্তিত মুখে বের হয়ে যাচ্ছিলেন, শুনলেন, জিবান ক্ষোতের সাথে বলছেন, আমার দুঃখ, কেউ-একজন আমাকে নির্বোধ হিসেবে জানে!
নীষ সারা রাত তাঁর বারান্দায় আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। কিম জিবানের সাথে কথা বলার পর হঠাৎ তাঁর সমস্ত জীবন অর্থহীন হয়ে গেছে। সারা জীবন জ্ঞানের অন্বেষণে কাটিয়েছেন, অজানাকে জানার যে-অদম্য তাড়না তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সেটি কোনো-এক বুদ্ধিমান প্রাণীর নির্দেশ। এই সত্যটি তিনি কোনোমতে মেনে নিতে পারছেন না। তাঁর কাছে এই জীবনের আর কোনো মূল্য নেই। তিনি দুই হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে থাকেন।
নীষের মাথায় হঠাৎ একটি প্রশ্ন জেগে ওঠে। এই যে বুদ্ধিমান প্রাণী, যারা মানবজাতিকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করছে, তারা ঠিক কী ভাবে মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখে? নীষ আজীবন ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যা চর্চা করে এসেছেন, মহাজাগতিক সংঘর্ষ কেন্দ্র তাঁর নিজের হাতে তৈরি করা, কোনো জটিল পরীক্ষা করায় তাঁর যে অচিন্তনীয় ক্ষমতা রয়েছে, তার কোনো তুলনা নেই। তিনি নিজেকে সেই অদৃশ্য বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে কল্পনা করলেন, তিনি যদি মানবজাতির সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতেন, তা হলে তিনি কী করতেন? ধরা যাক তিনি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটা প্রাণী, মানুষের আচার-ব্যবহার চিন্তাধারা যুক্তিতর্ক সবকিছু ভিন্ন। তিনি সেটা বোঝেন না, তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভব না। পিঁপড়া যেরকম কীটপতঙ্গের তুলনায় বুদ্ধিমান। কিন্তু মানুষ কখনো পিঁপড়ার সাথে ভাব বিনিময় করতে পারে না, অনেকটা সেরকম। তিনি এরকম অবস্থায় মানুষের সাথে কী ভাবে যোগাযোগ রাখতেন?
কেন? এ তো খুবই সহজ। নীষ হঠাৎ লাফিয়ে ওঠেন, মানুষের মতো কাউকে পাঠানো হবে, সে মানুষের সাথে মানুষের মতো থাকবে, তার ভিতর দিয়ে সব খোঁজ খবর নেয়া হবে।
নীষ উত্তেজিত হয়ে পায়চারি শুরু করেন, কে সে মানুষ, কোথায় আছে সে? নীষের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে, নিশ্চয়ই সেই মানুষ সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে থাকবে, এর চেয়ে ভালো জায়গা আর কী আছে? দশজন সদস্যের সবাইকে তিনি চেনেন, সবার সাথে ঘনিষ্ঠতা নেই, থাকা সম্ভবও নয়, কিন্তু সবাইকে খুব ভালো করে চেনেন। এদের মাঝে কে হতে পারে? মহামান্য লী? অসাধারণ প্রতিভাবান গণিতবিদ রু লুকাস? জীববিজ্ঞানী রুখ কিংবা শান সোয়ান? নাকি জ্যোতির্বিদ পল কুম? কে হতে পারে?
কী আশ্চর্য! নীষ ভাবলেন, আমি মূল কম্পিউটারকে জিজ্ঞেস করি না কেন? মূল কম্পিউটারে প্রত্যেকের জীবন-ইতিহাস আছে। একনজর দেখলেই বেরিয়ে পড়বে।
নীষ ছটে বসার ঘরে গেলেন। মনিটরকে স্পর্শ করে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান কাউন্সিলের দশজন সদস্যের জীবন-ইতিহাস জানতে চাইলেন মূল কম্পিউটারের কাছে। মূল কম্পিউটার আপত্তি জানাল, এটি গোপনীয়। তিনি জানতে চাইলে তাকে তার গোপন সংখ্যা প্রবেশ করাতে হবে। নীষ ধীরে ধীরে নিজের গোপন সংখ্যা প্রবেশ করালেন। এর জন্যে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে, সেটি গ্রহণযোগ্য না হলে তাঁকে নিজের হাতে নিজের প্রাণ নিতে হবে, কিন্তু একবারও তাঁর সে-কথাটি মনে হল না। নীষ একজন একজন করে প্রত্যেকের জীবন-ইতিহাস দেখতে থাকেন। তাঁর নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়ে আসে। হাত অল্প কাঁপছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কিন্তু তিনি জানেন, আজ তিনি বের করবেন কে সেই লোক। কে সেই আশ্চর্য বুদ্ধিমান-জগতের গুপ্তচর।
বিজ্ঞান কাউন্সিলের সর্বোচ্চ পরিষদের জরুরি সভা বসেছে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দশজন বিজ্ঞানী গোলটেবিল ঘিরে বসেছেন। তাঁদের মুখে মৃদু হাসি, তাঁরা নিচু স্বরে গন্ধ করছেন, এই মুহূর্তে তাঁদের সারা পৃথিবীতে টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে, তাই এই অভিনয়টুকুর প্রয়োজন। কিছুক্ষণের মাঝেই কোয়ার্টজের দরজাটি বন্ধ হয়ে তাঁদের সারা পৃথিবী থেকে আলাদা করে ফেলল। সাথে সাথে বিজ্ঞানীরা গম্ভীর হয়ে সোজা হয়ে বসলেন। সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের সভার কোনো নিয়ম নেই, মহামান্য লী সভাপতি হিসেবে এটি নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখার চেষ্টা করেন। আজ তিনিই সবার আগে কথা বললেন, তোমরা সবাই জান, গত ছত্রিশ ঘণ্টায় মূল কম্পিউটারে তিনবার গোপন সংখ্যা প্রবেশ করানো হয়েছে। জিবান দুর্বার, নীষ একবার।
আমার মনে হয়—জীববিজ্ঞানী রুখ বললেন, গোপন সংখ্যা প্রবেশ করানোর নিয়মটি তুলে দিতে হবে। জিবান সেটি যে-জন্য ব্যবহার করেছ—
রুখকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে জিবান বললেন, তোমরা এক সেকেন্ড থেকে আমাকে কথা বলতে দেবে?
রুখ আবার শান্ত স্বরে বললেন, আমার মনে হয়, যখন একজন কথা বলছে, তার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আরেকজনের অপেক্ষা করা উচিত। সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের সদস্য হিসেবে–
ধেত্তেরি তোমার সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদ। জিবান টেবিলে একটা থাবা দিয়ে বললেন, আমার কথা আগে শেষ করতে দাও। তিনি পকেট থেকে একগাদা কাগজ বের করে টেবিলের মাঝখানে ছুড়ে দিয়ে বললেন, এখানে সবকিছু লেখা আছে, দেখতে চাইলে দেখতে পার, কিন্তু এখন খামোকা সময় নষ্ট না করে আমার কথা শোন। আমি কিছুদিন থেকে সন্দেহ ছিলাম মানবজাতি আসলে এক ধরনের উন্নত প্রাণীর লাবরেটরি পরীক্ষা। গতকাল আমি নিঃসন্দেহ হয়েছি, যে-পরীক্ষা করে সন্দেহ মিটিয়েছি সেটি খুব সহজ, তোমরাও দেখতে পার। জিৰান পকেট থেকে লিটুমিন বোনাসিয়াসের অ্যাম্পলটা বের করলেন, এই বিষ দিয়ে পৃথিবীর সব মানুষকে মেরে ফেলা সম্ভব, পাতলা একটা কাচের অ্যাম্পুলে আছে, টাকা লাগালেই ভেঙে যাবার কথা। কিন্তু এটাকে ভাঙা সম্ভব না, কেউ-একজন এটাকে ভাঙতে দিচ্ছে না, তোমরা চেষ্টা করে দেখতে পার। জিবান অ্যাম্পুলটা টেবিলের উপর ছুড়ে দিলেন, সবাই রুদ্ধশ্বাসে অ্যাম্পুলটিকে লক্ষ করে, অ্যালটি সত্যি ফেটে না গিয়ে একটি রবারের বলের মতো বারকয়েক লাফিয়ে টেবিলের মাঝখানে স্থির হয়ে যায়।