নীষ কাঁপা কাঁপা হাতে অ্যাম্পলটা তুলে সেটির দিকে তাকিয়ে থাকেন, অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, জিবান।
বল।
তুমি কী ভাবে জানলে এরকম হবে?
জানতাম না, তাই তো পরীক্ষাটা করতে হল।
যদি তোমার অনুমান ভুল হত, যদি—
হয় নি তো।
যদি হত? যদি–
আহ! ছেলেমানুষি করা ছাড়, জিবান হাত নেড়ে নীষকে থামিয়ে দেন। নীষ সাবধানে কাচের অ্যাম্পুলটিকে টোকা দিয়ে বললেন, তুমি কেমন করে সন্দেহ করলে যে এরকম হতে পারে?
আমার সৌর তেজস্ক্রিয়তার উপরে প্রবন্ধটার কথা মনে আছে?
যেটা পরে ভুল প্রমাণিত হল? তুমি যে-পরিমাণ সৌর তেজস্ক্রিয়তা দাবি কর, সেটি সত্যি হলে পৃথিবী গত শতাব্দীতে ধ্বংস হয়ে যেত।
হ্যাঁ। কিন্তু আমার হিসেবে কোনো ভুল ছিল না, আমি এখনো আমার কোনো গবেষণায় কোনো ভুল করি নি।
তাহলে–
আমি খুঁজে বের করেছি, একটা আশ্চর্য উপায়ে মহাজাগতিক মেঘ এসে সময়মতো তেজস্ক্রিয়তাটুকু শুষে নিয়েছিল, কী ভাবে সেটা সম্ভব হল কেউ জানে না। তখন আমার প্রথম সন্দেহ হয় যে, কোনো-একজন বা কোনো দল আমাদের উপর চোখ রাখছে।
এ-ধরনের আরো ঘটনা আছে?
অসংখ্য। আমি মূল কম্পিউটার দিয়ে গত তিন শ বছরের প্রায় ধ্বংস ঘটনাগুলি দেখছিলাম। সাতানব্বই সালে পৃথিবীর দুটি বড় বড় নির্বোধ দেশ একজন আরেকজনকে ধ্বংস করার জন্যে পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। কোনো-একটি অজ্ঞাত কারণে একটি মিসাইলও মাটি ছেড়ে উপরে ওঠে নি।
আশ্চর্য।
হ্যাঁ, একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে গ্রীন হাউস এফেক্ট-এর জন্যে পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমস্ত পৃথিবী ডুবে যাবার কথা ছিল। কোনো-এক অজ্ঞাত কারণে সে-সময়ে হঠাৎ কএ পৃথিবীর সমস্ত সবুজ গাছপালা সালোকসংশ্লেষণে দ্বিগুণ পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করা শুরু করায় পৃথিবী রক্ষা পেয়েছে।
নীষ মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, আমি এটা জানতাম।
তুমি নিশ্চয়ই কিনিকা ধূমকেতুর কথা পড়েছ? সেটি পৃথিবীকে আঘাত করে কক্ষচ্যুত করে ফেলার মতো বড় ছিল। কিন্তু ইউরেনাসের কাছে এক আশ্চর্য কারণে সেটি বিস্ফোরিত হয়ে গতিপথ পরিবর্তন করেছিল। গত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে একটা আশ্চর্য রোগ মহামারী আকারে দেখা দেয়, এতে মানুষের রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা শেষ হয়ে যেত। রোগটি ছড়িয়ে পড়ার আগেই নিজে থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল।
আশ্চর্য।
হ্যাঁ, এরকম অসংখ্য আশ্চর্য ঘটনা আছে, মূল কম্পিউটার সেগুলি খুঁজে বের করছে। তুমি দেখতে চাইলে দেখতে পার। জিবান হাত দিয়ে মনিটরকে স্পর্শ করামাত্র কম্পিউটারটি দেয়ালে ঘটনাগুলো লিখতে লিখতে হালকা স্বরে পড়তে থাকে। জিবান বললেন, সবগুলো শুনতে চাইলে ঘণ্টা তিনেক সময় লাগবে, সব মিলিয়ে এরকম প্রায় ছয় শ ঘটনা আছে।
নীষ মিনিট দশেক দেখেই কম্পিউটারটিকে থামিয়ে দিলেন। তাঁর দুহাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এসেছে। তিনি জিবানের দিকে তাকিয়ে বললেন, তার মানে তুমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলে?
হা। এই কাচের অ্যাম্বুলটা ভাঙার চেষ্টা করে এখন পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হয়েছি। এখন আমি জানি এবং তুমিও জান, কেউ-একজন আমাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
তার মানে–
তার মানে আমরা একটা ল্যাবরেটরির ছোট ছোট গিনিপিগ। আমাদের দিয়ে কেউ একজন একটা পরীক্ষা করেছে। যে বা যারা এই পরীক্ষাটা করছে, তারা লক্ষ রাখছে নির্বোধ গিনিপিগগুলো যেন কোনোভাবে মারা না যায়।
নীষের নিজেকে একটা নির্বোধ মনে হল, তবু তিনি প্রশ্নটা না করে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কী পরীক্ষা করছি?
জিবান আবার হাসলেন, বললেন, আমরা কোনো পরীক্ষা করছি না, আমাদের দিয়ে পরীক্ষা করানো হচ্ছে।
সেটি কি?
আমি এখনো নিশ্চিত জানি না সেটি কী। এই মুহূর্তে মূল কম্পিউটার সেটি বের করার চেষ্টা করছে। পৃথিবীতে মানুষের যত অবদান, সবগুলোকে নিয়ে সে একটা সম্পর্ক বের করার চেষ্টা করছে। লক্ষ করছে তার ভিতরে কোনো লুকানো সাদৃশ্য আছে কি না, কোনোভাবে সেগুলো অদৃশ্য কোনো শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কি না। অসংখ্য রাশিমালা নিয়ে অনেক জটিল হিসেব করতে হচ্ছে বলে কম্পিউটারের এত সময় লাগছে। কাল ভোরের আগে উত্তর বের করার কথা, কিন্তু আমি মোটামুটি জানি, উত্তর কী হবে। তুমিও নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পেরেছ।
হ্যাঁ। নীষ মাথা নাড়লেন, জ্ঞান-সাধনা?
ঠিক বলেছ। মানব জাতির ইতিহাস হচ্ছে তার জ্ঞান সাধনার ইতিহাস, অথচ কী লজ্জার কথা, সেটি আসলে অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর কাজ।
নীষ হঠাৎ মাথা তুলে বললেন, আমাকে তুমি এটা জানিয়েছ কেন? নিজের অজ্ঞাতেই তার কণ্ঠে ক্ষোভ ফুটে ওঠে।
আমি ছাড়াও আরো কেউ এটা জানুক।
কেন?
আমার যদি কোনো কারণে মৃত্যু হয়, অন্তত আরেকজন মানুষ এটা নিয়ে মাথা ঘামাতে পারবে।
নীষ উঠে দাঁড়ালেন, আমাকে একা বসে খানিকক্ষণ ভাবতে হবে। আমি যাই।
যাও।
নীষ দরজার কাছ থেকে ঘুরে এসে জিবানকে বললেন, এই অদৃশ্য শক্তি, যারা আমাদের ব্যবহার করছে, তারা তোমাকে মেরে ফেলল না কেন? যেই মুহূর্তে তোমার মাথায় সন্দেহটুকু উঁকি দিয়েছে–
আমি নিজেও এটা নিয়ে ভেবেছি, হয়তো তাদের চিন্তাধারা আর আমাদের চিন্তাধারার তুলনা করা যায় না। হয়তো আমরা যেভাবে ভাবি, আমাদের যে ধরনের যুক্তিতর্ক, তাদেরটা সে রকম নয়, অন্যরকম অনেকটা যেন মানুষ আর পিঁপড়া। আমি যদি অনেকগুলো পিঁপড়াকে নিয়ে একটা পরীক্ষা করি আর হঠাৎ দেখি একটা পিঁপড়া বোকার মতো একটা কাজ করছে, যেটা দিয়ে অন্য সবগুলো পিঁপড়া মারা যাবে, আমি তখন কী করব? আমি সেই পিঁপড়াটাকে বোকার মতো কাজ করতে দেব না। কিন্তু পিঁপড়াটাকে তো মেরে ফেলব না, সেটাকে ছেড়ে দেব। নির্বোধ প্রাণী, ওকে মেরে লাভ কি?