অ্যাম্পুলটির মুখ বন্ধ হয়ে যাবার পর তিনি সেটা হাতে নেয়ার জন্যে ক্রায়োজেনিক পাম্পটা বন্ধ করে দেন। ভিতরে বাতাসের চাপ স্বাভাবিক হওয়ার পর তিনি বায়ুনিরোধক বাক্সটির ঢাকনা খোলার জন্যে হাতল স্পর্শ করামাত্র মূল কম্পিউটারটি আপত্তি জানাল। পৃথিবীতে মাত্র দশজন মানুষকে এই ঢাকনা খোলার অধিকার দেয়া হয়েছে। তিনি সেই দশজন মানুষের একজন। কিম জিবানকে দ্বিতীয়বার তাঁর নিজের হাতে গোপন সংখ্যাটি প্রবেশ করিয়ে কম্পিউটারকে জানাতে হল। বায়ুনিরোধক বাক্সটির ঢাকনা এবার সহজেই খুলে আয়) জিবানের হাত অল্প অল্প কাঁপতে থাকে, তিনি সে অবস্থাতেই সাবধানে অ্যালতি তুলে নেন। তিনি এখন তাঁর জীবনের প্রথম এবং সম্ভবত শেষ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাটি করবেন। তাঁর হাতে কাচের অ্যাম্পুলটি কোনোভাবে ভেঙে গেলে এই তরল পদার্থটি বাতাসে মিশে গিয়ে আগামী চব্বিশ ঘণ্টার ভিতরে পৃথিবীর প্রতিটি জীবিত প্রাণীকে মেরে ফেলবে। মাত্র তিন ধরনের ভাইরাস এই বোনাসিয়াস থেকে রক্ষা পেতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ লন। কিম জিবান হেঁটে ঘরের মাঝখানে আসেন, তাঁর হাত তখনো অল্প অল্প কাঁপছে, তিনি ভালো করে অ্যাম্পুলটি ধরে রাখতে পারছেন না। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের প্রাণ তিনি এখন হাতে ধরে রেখেছেন, কিম জিবান অবাক হয়ে ভাবলেন, এত বড় ক্ষমতা স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ কি কখনো অর্জন করেছিল?
নীষ কিম জিবানের ঘরে ঢুকে আবিষ্কার করেন, ঘরাট অন্ধকার। বাতি জ্বালানোর চেষ্টা করতেই অন্ধকারে এক কোনা থেকে জিবান বললেন, নীষ, বাতি জ্বালিও না। একটু পরেই দেখবে চোখ অন্ধকারে সয়ে যাবে।
বাজে কথা বলো না—নীষ বাতি জ্বালালেন, আমার অন্ধকার ভালো লাগে না।
জিবান চোখ কুঁচকে নীষের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তাঁর মুখে আশ্চর্য একটা হাসি। নীষ বেশি অবাক হলেন না। কিম জিবান বরাবরই খেয়ালি মানুষ, এরকম একজন খেয়ালি মানুষকে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের সদস্য করা হয়েছে, সেটাই আশ্চর্য! নীষ বললেন, কী ব্যাপার জিবান, আমাকে ডেকেছ কেন?
জিন কথা না বলে ঘরের কোনায় তাঁর ছোট ল্যাবরেটরি দেখালেন, নীষ বিস্মিত হয়ে সেদিকে এগিয়ে যান, কী ব্যাপার জিবান, তুমি ডিষ্টিলেশান কমপ্লেক্স দিয়ে কী করছ?
জিবান মাথা দুলিয়ে হেসে বললেন, তুমি পৃথিবীর প্রথম পাঁচজন ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন–
কথাটি সত্যি তাই নীষ প্রতিবাদ না করে পরের অংশটক শোনার জন্যে অপেক্ষা করে রইলেন। জিবান বললেন, তুমিই বল আমি কী করছিলাম।
নীষ মিনিট দুয়েক ডিস্টিলেশান কমপ্লেক্সের দিকে তাকিয়ে থাকেন, কম্পিউটারের মনিটরে বার দুয়েক টোকা দিয়ে হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলেন, তখন তিনি ঘুরে জিবানের দিকে তাকিয়েছেন, তাঁর মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। নীষ কথা বলতে পারছিলেন না, বারকয়েক চেষ্টা করে কোনোতাবে বললেন, তুমি—তুমি উন্মাদ হয়ে গেছ। তুমি কাচের অ্যালে লিটুমিন বোনাসিয়াস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ।
জিবান পকেট হাতড়ে অ্যাম্পুলটি বের করে তাঁকে দেখালেন। আতঙ্কে নীষের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, মনে হতে থাকে তাঁর হৃৎস্পন্দন থেমে যাবে, এই কাচের অ্যালটি কোনোভাবে ভেঙে গেলে চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ শেষ হয়ে যাবে। জিবান তখনো হাসিমুখে নীষের মুখের জিকে তাকিয়ে আছেন, আস্তে আস্তে তাঁর হাসি আরো বিস্তৃত হয়ে ওঠে, তিনি হঠাৎ অবহেলার ভঙ্গিতে অ্যাম্পুলটি নীষের দিকে ছুড়ে দেন।
নীষ পাগলের মতো লাফ দিয়ে অ্যাম্পুলটি ধরার চেষ্টা করলেন। হাত ফসকে সেটি পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেটি ধরে ফেলেছেন। হাতের মুঠোয় রেখে তিনি বিস্ফারিত চোখে আঙ্গুলটির দিকে তাকিয়ে থাকেন, তাঁর সমস্ত মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। নীষ ধীরে ধীরে জিবানের মুখের দিকে তাকালেন।
জিবানের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে, তাঁর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বললেন, আলটি ফিরিয়ে দাও।
না।
জিন ডুয়ার খুলে ভিতর থেকে একটা বেঢপ রিভলবার বের করলেন, আমাকে ফিরিয়ে দিলে আলটি রক্ষা পাবার সম্ভাবনা বেশি, তোমাকে গুলি করলে অ্যাম্পুলটি হাত থেকে পড়ে ভেঙে যেতে পারে।
জিনা তুমি—
অ্যাম্পুলটি ফিরিয়ে দাও।
নীষ কাঁপা কাঁপা হাতে অ্যাম্পুলটি ফিরিয়ে দিলেন। জিবান অ্যালটি টেবিলের উপর রেখে নীষ কিছু বোঝার আগে ট্রিগার টেনে সেটিকে গুলি করে বসেছেন।
প্রচণ্ড শব্দ হল ঘরে, কাচের অ্যাম্পুলটি ছিটকে গিয়ে দেয়ালে আঘাত খেয়ে মেঝেতে এসে পড়ে এক কোনায় গড়িয়ে যায়। নীষ বিস্মিত হয়ে দেখেন—অ্যাম্পুলটি ভাঙে নি, সেটির গায়ে একটু দাগ পর্যন্ত নেই। তিনি ঘুরে জিবানের দিকে তাকান, জিবানের মুখে আবার সেই ছেলেমানুষি হাসি ফিরে এসেছে। বেঢপ রিভলবারটি ড্রয়ারে রাখতে রাখতে বললেন, তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যে দুঃখিত নীষ, কেন জানি একটু মজা করার ইচ্ছে হল। এটি আমার এক শ উনিশ নম্বর গুলি, আমি এটাকে গত ছত্রিশ ঘণ্টা থেকে ভাঙার চেষ্টা করছি।
নীষ কোনোমতে একটা চেয়ার ধরে বসে পড়েন। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বলেন, তুমি বলতে চাও এটি সাধারণ কাচ, অথচ–
হ্যাঁ, যেই মুহূর্তে এর ভিতরে বোনাসিয়াস ঢোকানো হয়েছে, এটা আর ভাঙা যাচ্ছে না। একটু থেমে যোগ করলেন, কেউ-একজন পৃথিবীর মানুষকে মরতে দিতে চায় না।