রিগা নিজেকে মুক্ত করে বলল, না প্রফেসর ত্রিনি। আমার কাছে আজকের খবরের বুলেটিন আছে। দেখবেন?
প্রফেসর ত্রিনির উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করেই রিগা হাতের রেম কার্ডটির সুইচ অন করে দিল, সাথে সাথে ঘরের মাঝখানে মিষ্টি চেহারার একজন মেয়ের জীবন্ত ত্রিমাত্রিক ছবি ভেসে ওঠে। দিন তারিখ সন বলে খবর বলা শুরু হয়ে যায়।
প্রফেসর ত্রিনি এবং লিকের বিস্ফারিত চোখের সামনে রিগা সুইচ টিপে রেম কার্ডটি বন্ধ করে দিল। খবরের বিষয়বস্তু, নাকি ত্রিমাত্রিক ছবির এই বৈপ্লবিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি—কোনটি তাদের বাক্যহারা করে দিয়েছে বোঝা গেল না। খুব সাবধানে প্রফেসর লিক একটা গোলাকার আসনে বসে পড়ে প্রফেসর ত্রিনির মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ত্রিনি, মনে আছে, আমরা আরেকটা সলিউশান পেয়েছিলাম, বিশ্বাস করি নি তখন। সেটাই কি সত্যি? কিন্তু সেটা তো অসম্ভব–
প্রফেসর ত্রিনি ফ্যাকাসে মুখে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে ছিলেন, আস্তে আস্তে বললেন, আজ বিকেলে আমার মেয়ের জন্মদিন। আমার কেক কিনে নিয়ে যাবার কথা ছিল—দু শ বছর আগে ছিল সেটা? দুশ বছর?
তিনি হঠাৎ নিজের মুখ ঢেকে হু-হু করে কেঁদে উঠলেন।
রিগা খুব ধীরে ধীরে শোনা যায় না এরকম গলায় বলল, আমি দুঃখিত প্রফেসর ত্রিনি। খুবই দুঃখিত।
প্রফেসর ত্রিনি হঠাৎ মুখ তুলে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর কঠোর মুখে বললেন, আমি বিশ্বাস করি না। আমি বাইরে যাব–
প্রফেসর লিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ত্রিনির দিকে। তারপর বললেন, ত্রিনি, তুমি তো জান, যদি দ্বিতীয় সমাধানটি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তুমি বাইরে যেতে পারবে না
কে বলেছে পারব না, এক শ বার পারব।
কিন্তু তাহলে সময় সমাপনী নীতির লংঘন হবে।
হোক।
তার মানে তুমি জান বস্তু আর অবস্থানের অবলুপ্তি ঘটবে। তুমি থাকবে কিন্তু তোমার চারপাশের পৃথিবী উড়ে যাবে।
যাক—আমার কিছু আসে যায় না। আমি বাইরে যাব।
প্রফেসর ত্রিনি দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন, রিগা পিছন থেকে তাঁকে ডাকল, প্রফেসর ত্রিনি, আমার ধারণা, আপনি বাইরে যেতে পারবেন না। আপনি চাইলেও পারবেন না।
কেন?
আমি এখানে এসেছি প্রায় সাত মিনিটের মতো হয়ে গেছে। তার মানে জানেন?
কি?
পৃথিবীতে আরো পঞ্চাশ বছর সময় পার হয়ে গেছে।
প্রফেসর ত্রিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন, তাতে কী হয়েছে?
আমি এখানে এসেছি গোপনে, কেউ জানে না। কিন্তু আমার ডাইরিটা আমি রেখে এসেছি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভন্টে। সেটা এতদিনে পৃথিবীর মানুষ পেয়েছে।
পেলে কী হবে?
তারা জানবে আমি এই ল্যাবরেটরির সবগুলো দরজা খুলে ভিতরে এসে ঢুকেছি, আপনারা এখন ইচ্ছে করলে বের হয়ে যেতে পারবেন। পৃথিবীর মানুষ সময়ের অপবলয়ের সূত্রের সমাধান করেছে, তারাও জানে দ্বিতীয় সমাধানটি সত্যি। তারাও এখন জেনে গেছে এই ছোট ঘরে আমরা তিনজন স্থির সময়ের ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি, আমরা বের হয়ে গেলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা সেটা হতে দেবে না। কিছুতেই হতে দেবে না।
কী করবে তারা?
কাউকে পাঠাবে এখানে। যারা আমাদের তিনজনকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে পৃথিবীকে রক্ষা করবে।
কাকে পাঠাবে? প্রফেসর ত্রিনির গলা কেঁপে গেল হঠাৎ।
আমার ধারণা, সেগুরি-৪৯ ধরনের রবোটকে। অত্যন্ত নিঁখুত রবোট, অত্যন্ত সুচারুভাবে কাজ করতে সক্ষম। আমার ধারণা যে-কোনো মুহূর্তে তারা এসে ঢুকবে এখানে।
বিশ্বাস করি না তোমার কথা। বিশ্বাস করি না–
রিগা কী-একটা বলতে চাইছিল, তার আগেই হঠাৎ সশব্দে দরজা খুলে যায়। দরজায় চারটি ধাতবমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। চোখে নিষ্পলক দৃষ্টি, হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। মূর্তিগুলো মাথা ঘুরিয়ে তাদের তিনজনকে একনজর দেখে নেয়। তারপর খুব ধীরে ধীরে হাতের অস্ত্র তাদের দিকে উদ্যত করে। রিগা চিনতে পারে—সেঞ্চুরি-৪১ রবোট।
ছোট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিগা। তার অনুমান তাহলে ভুল হয় নি। কখনো হয় না।
০৩. বিষ
ক্রায়োজেনিক পাম্পটি চালিয়ে দিয়ে কিম জিবান কাচের ছোট অ্যাম্পুলটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে তিনি কখনো একটা ক্ষুদ্রাইভার হাতে একটা স্কু ঘুরিয়েছেন মনে পড়ে না, অথচ গত এক সপ্তাহ থেকে তাঁর ঘরে একটা ছোট কিন্তু জটিল ল্যাবরেটরি বসানোর কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের দশজন সদস্যের একজন হিসেবে তাঁর ক্ষমতার আক্ষরিক অর্থেই কোনো সীমা নেই। মূল কম্পিউটার তাঁর মুখের কথায় এই ল্যাবরেটরির প্রতিটি জিনিস এনে হাজির করেছে। কিন্তু কাচের অ্যাম্পুলটিতে তিনি যে তরল পদার্থটি রাখতে চাইছেন, সেটি কী ভাবে তৈরি করতে হয় সেই তথ্যটি তিনি মুখের কথায় বের করতে পারেন নি। সেজন্যে তাঁকে নিজের হাতে তাঁর সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের গোপন সংখ্যাটি মূল কম্পিউটারে প্রবেশ করাতে হয়েছে। পৃথিবীর সুদীর্ঘ ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কেউ সেটি করেছে বলে জানা নেই। এজন্যে তাঁকে সামনের কাউন্সিলে জবাবদিহি করতে হবে, সেটি গ্রহণযোগ্য না হলে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তাঁর নিজের হাতে নিজের প্রাণ নেয়ার কথা।
জিন স্থির দৃষ্টিতে কাচের অ্যালটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। হালকা লাল রঙের একটা তরল একফোঁটা একফোঁটা করে কাচের অ্যাম্পলটিতে জমা হচ্ছে। পুরোটুকু ভরে যাওয়ার পর অ্যাম্পুলটির মুখ লেজারের একঝলক আলোতে গলিয়ে বন্ধ করে ফেলার কথা। তিনি কখনো আগে এ ধরনের কাজ করেন নি, তাই নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হতে চান।