আমি কাউকে হত্যা করি নি। রিগা কম্পিউটার আমার ছবি পাল্টে দিয়েছে।
ট্রাকিওশানটি হঠাৎ চুপ করে গেল। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলাম, আমার স্নায়ু টানটান হয়ে রইল অভাবিত কিছু একটা ঘটার জন্য কিন্তু কিছু ঘটল না। আমি ভয়ে ভয়ে ট্রাকিওশানকে ডাকলাম, তুমি কোথায়?
আমি আছি। তোমার সাথেই আছি।
তুমি কেন চুপ করে আছ?
আমি রিগা কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ করছি। তার সাথে কথা বলছি।
আমি চুপ করে বসে রইলাম। ট্রাকিওশানটি রিগা কম্পিউটারের সাথে কথা বলছে, আমি কি কারো সাথে কথা বলতে পারি না? কেউ কি নেই এই পৃথিবীতে যে আমাকে সাহায্য করতে পারে? আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমার মতো অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া মানুষ আসলেই বড় নিঃসঙ্গ। বড় অসহায়। বড় দুঃখী।
ঠিক এই সময়ে আমার লানার কথা মনে পড়ল। সোনালি চুল এবং নীল চোখের সেই মেয়েটি যে প্রতিরক্ষা দপ্তরের দ্বিতীয় কমান্ডিং অফিসার। যে আমাকে প্রতিরক্ষাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার কথা বলেছিল, চলে যাওয়ার সময় তার হলোগ্রাফিক মালটিকমিউনিকেশান্স কার্ডটি আমাকে দিয়েছিল। আমি পকেটে হাত দিতেই চতুষ্কোণ কার্ডটির শীতল স্পর্শ অনুভব করলাম। জোর করে আমাকে অচেতন করে আমার মাথায় অস্ত্রোপচার করার সময় এই কার্ডটি ইচ্ছে করলে ফেলে দিতে পারত, কিন্তু তারা ফেলে দেয় নি। আমি কার্ডটি বের করে লাল বোতামটি স্পর্শ করতেই কার্ডটিতে এক ধরনের ভোঁতা শব্দ হল, ছোট ছোট দুটি বাতি জ্বলে উঠল এবং হঠাৎ করে আমার সামনে ছোট একটি স্ক্রিনে লানার ত্রিমাত্রিক একটা ছবি ফুটে উঠল। লানা উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করল, কে? কে আমার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে!
আমি। আমি কিরি।
কিরি! কী ব্যাপার? তোমার কী হয়েছে?
আমি–আমি খুব বড় বিপদে পড়েছি লানা।
কী বিপদ?
সেটি অনেক বড় ইতিহাস–তোমাকে কীভাবে বুঝিয়ে বলব জানি না।
চেষ্টা কর।
আমার মাথায় একটা ট্রাকিওশান লাগানো হয়েছে।
ট্রাকিওশান! লানা আর্তনাদ করে উঠল, কেন?
আমি নাকি একজনকে খুন করেছি।
লানা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে অনিশ্চিতের মতো বলল, খুন?
কিন্তু আমি খুন করি নি। রিগা কম্পিউটার মিথ্যা বলছে।
লানা শিস দেওয়ার মতো একটা শব্দ করে নিচু গলায় বলল, তুমি সত্যি সত্যি খুব বড় বিপদে পড়েছ কিরি।
আমি জানি।
তোমাকে সাহায্য করা যাবে কি না আমি জানি না। কিন্তু আমি চেষ্টা করব।
লানা!
বল।
যদি খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা করা না হয় তা হলে আমাকে আর কেউ কোনোদিন সাহায্য করতে পারবে না।
আমারও তাই মনে হয়।
.
প্রতিরক্ষা দপ্তরের কমান্ডিং অফিসারদের যেটুকু ক্ষমতা রয়েছে বলে আমি ধারণা করেছিলাম দেখা গেল তাদের ক্ষমতা তার থেকেও বেশি। কয়েক ঘণ্টার মাঝেই আমাকে বিশাল একটা হলঘরে এনে হাজির করা হল। হলঘরটিতে আবছা অন্ধকার, দেয়াল প্রায় দেখা যায় না। অনেক উঁচু ছাদ; সেখান থেকে এক ধরনের স্বচ্ছ নরম আলো বের হচ্ছে। ঘরের মাঝখানে কুচকুচে কালো কৃত্রিম গ্রানাইটের টেবিল। টেবিলের একপাশে উঁচু আরামহীন একটা শক্ত চেয়ারে আমি সোজা হয়ে বসে আছি। আমার সামনে টেবিলের অন্যপাশে তিন জন মাঝবয়সী মানুষ। এক জন পুরুষ, এক জন মহিলা, তবে তৃতীয় জন নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। সে পুরুষ কিংবা মহিলা দুই–ই হতে পারে, আধুনিক কোনো রোবট হলেও অবাক হব না। পুরুষমানুষটি তার সামনে রাখা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে কিছু একটা দেখছে, স্ক্রিনটা আমার দৃষ্টিসীমা থেকে আড়াল করে রাখা আছে বলে মানুষটা কী দেখছে আমি জানি না। তার। মুখভঙ্গি এবং মাঝে মাঝে সূক্ষ্ম এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকানোর ভঙ্গি দেখে। মনে হচ্ছিল সম্ভবত সেখানে আমার সম্পর্কে কোনো তথ্য রয়েছে। আমি বেশ কিছুক্ষণ হল এভাবে বসে আছি, নিজে থেকে কথা শুরু করার কথা নয় কিন্তু ভিতরে ভিতরে অধৈর্য হয়ে আছি বলে হয়তো চেষ্টা করে দেখতে পারি। যদিও গত কয়েক ঘণ্টা আমার মস্তিষ্কে বসানো ট্রাকিওশানটি আমাকে কোনোভাবে উত্ত্যক্ত করছে না কিন্তু আমি ভিতরে ভিতরে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করছি, ট্রাকিওশানটি হঠাৎ করে চালু হয়ে গেলে আমি স্বাভাবিকভাবে কথাও বলতে পারব বলে মনে হয় না।
আমার সামনে বসে থাকা মহিলাটি হঠাৎ চোখ তুলে বলল, তুমি আমাদের কাছে কী চাও?
আমাকে অন্যায়ভাবে একটা খুনের—
অপ্রয়োজনীয় কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। মহিলাটি অনাবশ্যক রূঢ়তা ব্যবহার করে আমাকে থামিয়ে দিল। আমি আগেও লক্ষ করেছি একজন মেয়ে যত সহজে কোমল ব্যবহার করতে পারে ঠিক তত সহজে রূঢ় ব্যবহার করতে পারে।
মহিলাটি গ্রানাইটের টেবিলে তার চমৎকার নখ দিয়ে শব্দ করে বলল, তুমি ঠিক কী চাও?
আমি একমুহূর্ত চিন্তা করে বললাম, আমার মস্তিষ্কে যে ট্রাকিওশানটি বসানো হয়েছে সেটা সরাতে চাই।
মহিলাটি সহৃদয়ভাবে হাসল, বলল, এই তো চমৎকারভাবে ঠিক বিষয়ে কথা বলতে শিখে গেছ। তবে তোমার এই ইচ্ছাটি পূরণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। প্রতিরক্ষা দপ্তর বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তে নাক গলাতে পারে না।
পারে।
আমার কথা শুনে পুরুষ এবং মহিলা দুজনেই একটু চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। তৃতীয় মানুষটির কোনো ভাবান্তর হল না, এক ধরনের উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মহিলাটি ভুরু কুঁচকে বলল, পারে?