আমার কথা শেষ করার আগেই দুজনের মাঝে অপেক্ষাকৃত লম্বা মানুষটি পোশাকের ভিতর থেকে একটা জিরকনালাইটের ছোরা বের করে আনে, কোথায় একটা চাপ দিতেই ধারালো ফলাটা বের হয়ে আসে। কৃত্রিম জ্যোৎস্নার আলোতেও আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম ছোরার ফলায় সাদা পাউডারের মতো নিহিলা বিষ চকচক করছে। পেশাদার অপরাধীরা আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করে মাঝে মাঝে নিহিলা বিষ মাখানো জিরকনালাইটের ছোরা ব্যবহার করে শুধুমাত্র অমানুষিক যন্ত্রণা দেবার জন্য।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি ঐ ছোরাটা ব্যবহার করতে পারবে না। তার অনেক আগেই আমি তোমাকে শেষ করে দেব।
মানুষটি আমার কথা বিশ্বাস করল না, ছোরা হাতে আমার দিকে লাফিয়ে এল, আমি সরে গিয়ে তার চোয়ালে একটা ঘুষি দিতে গিয়ে থেমে গেলাম। কারণ ঠিক তখন খাটো মানুষটি একটা প্রাচীন স্টান্টগান আমার দিকে তাক করে গুলি করার জন্য এগিয়ে এসেছে। আমি ঘুরে প্রায় তাদের উপর দিয়ে লাফিয়ে সরে এলাম, মানুষ দুজন একসাথে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে একজন আরেকজনকে জাপটে ধরল। আমি দেখতে পেলাম দীর্ঘকায় মানুষটি তার হাতে উদ্যত জিরকনালাইটের ছোরা উঁচু করে ধরেছে, পরমুহূর্তে অন্য মানুষটি অমানুষিক যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল–ভুল করে তার পাজরে ছোরা প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে।
নিহিলা বিষের যন্ত্রণা যে এত মারাত্মক আমি জানতাম না। মানুষটি অমানুষিক যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে আমার সামনেই কয়েকটা খিচুনি দিয়ে হঠাৎ নিথর হয়ে গেল। দীর্ঘকায় মানুষটি তখনো হতচকিতের মতো জিরকনালাইটের রক্তাক্ত ছোরাটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, আমি কখনো ভাবি নি আমি একটা হত্যাকাণ্ড দেখব। আমার আত্মাকে তুমি আজকে দূষিত করে দিলে নির্বোধ মানুষ।
.
কালো গ্রানাইটের টেবিলের অন্য পাশে একটি প্রতিরক্ষা রোবট এবং দুজন আইনরক্ষাকারী অফিসার বসে আছে। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী অফিসারটি আমার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে তৃতীয়বারের মতো জিজ্ঞেস করল, কেন তুমি এই উচ্ছঙ্খল মদ্যপ মানুষটিকে হত্যা করলে?
আমি তৃতীয়বার শান্ত গলায় বললাম, আমি এই মানুষটিকে হত্যা করি নি।
মানুষটি একটু অধৈর্য হয়ে বলল, তুমি কেন এখনো অর্থহীন কথা বলছ? তুমি যেখানে মানুষটিকে হত্যা করেছ ঠিক তার কাছে একটা দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউল রয়েছে। পুরো ঘটনাটি নিখুঁতভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। আমরা পরিষ্কার দেখেছি–
আমি বিশ্বাস করি না।
দ্বিতীয় অফিসারটি একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, তুমি বিশ্বাস না করলে কিছু আসে–যায়। যেটি সত্যি সেটি সত্যিই থাকবে।
আমি দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউলের ছবিটি দেখতে চাই।
সময় হলেই তুমি দেখবে। রিগা কম্পিউটারের সামনে যখন আত্মপক্ষ সমর্থন করবে তখন তোমাদের পুরো ঘটনাটি দেখানো হবে।
আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, তোমরা ব্যাপারটি বুঝতে পারছ না। এখানে একটা বড় ভুল হয়েছে। ঘটনাটি যদি আমাকে দেখাও আমি তোমাদের বলে দিতে পারি কোথায় ভুলটি হয়েছে।
কমবয়সী অফিসারটি হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে রোবটটির দিকে ইঙ্গিত করতেই ঘরের মাঝামাঝি ত্রিমাত্রিক একটা ছবি দেখা যেতে শুরু করল। ছবিতে আমি নিজেকে দেখতে পেলাম, আমার সামনে চার জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। খাটো মানুষটি আমাকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ করছে এবং হঠাৎ করে দুই জন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি তার আগেই প্রচণ্ড আঘাতে তাদের নিচে ফেলে দিয়েছি। এর পরের দৃশ্যটি দেখে হঠাৎ আমার শরীর শীতল হয়ে গেল। আমি স্পষ্ট দেখলাম আমি আমার পোশাকের ভিতর থেকে জিরকনালাইটের ধারালো ছোরা বের করে এনেছি। অসম্ভব ব্যাপার, এটি কী করে সম্ভব? আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই দেখতে পেলাম আমি ধারালো ছোরা দিয়ে খাটো মানুষটিকে আঘাত করেছি। মানুষটি প্রচণ্ড আর্তনাদ করে নিচে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল।
হলোগ্রাফিক দৃশ্যটি যেরকম হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল ঠিক সেরকম হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল। কমবয়সী অফিসারটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন বল তোমার কী বলার আছে।
আমি একটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে বললাম, আমার কিছু বলার নেই।
কিছু বলার নেই? বলবে না কেন মানুষটিকে কোনো প্ররোচনা ছাড়া আঘাত করলে?
আমি মাথা নাড়লাম, আমি আঘাত করি নি। দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউল যে ছবি তুলেছে সেটার পরিবর্তন করা হয়েছে।
পুলিশ অফিসারটি এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যেন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ কাঠ কাঠ স্বরে হা হা করে হেসে উঠে বলল, তুমি কি সত্যিই আমাদেরকে এটা বিশ্বাস করতে বল? রিগা কম্পিউটার একটা অপরাধ–দৃশ্যের পরিবর্তন করেছে? আমরা যদি রিগা কম্পিউটারকে অবিশ্বাস করি তা হলে বিশ্বাস করব কিসে?
আমি চুপ করে রইলাম। প্রাচীনকালে মানুষ যেভাবে ঈশ্বরকে বিশ্বাস করত এখন সেভাবে রিগা কম্পিউটারকে বিশ্বাস করা হয়। ঈশ্বরকে অবমাননা করার জন্য প্রাচীনকালে মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, রিগা কম্পিউটারকে অবিশ্বাস করার জন্যও কি আমাকে সেভাবে শাস্তি দেওয়া হবে?
তুমি কথা বলছ না কেন?
আমি সাধারণ মানুষের সাথে লড়তে পারি। কিন্তু রিগা কম্পিউটারের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়ব? আমার কী বলার থাকতে পারে?