আমি সেরকম একজন?
হ্যাঁ। লানা কথা না বলে আমার পাশে পাশে কিছুক্ষণ হাঁটতে থাকে। আমি কী নিয়ে কথা বলব ঠিক বুঝতে না পেরে শহরের তাপমাত্রা নিয়ে একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন মেয়েটা বলল, তুমি কি প্রতিরক্ষাবাহিনীতে যোগ দিতে চাও?
আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম, কী বলব বুঝতে না পেরে হাসার ভঙ্গি করে বললাম, তোমার ধারণা আমি খুব সাহসী মানুষ, আমি আসলে ভীত এবং দুর্বল।
ভীতি, দুর্বলতা এসব হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্কের এক ধরনের ইলেকট্রো কেমিক্যাল বিক্রিয়া। ছোট একটা ক্যাপসুল দিয়ে সে সব কিছু দূর করে দেওয়া যায়।
আমি ওই মেয়েটির দিকে আবার তাকালাম, আমার হালকা কথাবার্তাকে মেয়েটা সহজভাবে না নিয়ে গুরুগম্ভীর কথা বলতে শুরু করেছে। সত্যি সত্যি আমাকে নিশ্চয়ই প্রতিরক্ষাবাহিনীতে নিতে চায়। আমি মুখটা একটু গম্ভীর করে বললাম, দেখ, আজকে পানশালায় আমি যে কাজটা করেছি সেটা করেছি হঠাৎ করে একটা ঝোঁকের মাথায়। এ ধরনের ভায়োলেন্ট কাজ আমি শুধুমাত্র ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ করেই করতে পারব। ঠাণ্ডা মাথায় কখনো করতে পারব না।
কিন্তু
আমি বাধা দিয়ে বললাম, আমাকে শেষ করতে দাও। শুধু যে করতে পারব না তাই নয়, আমি করতেও চাই না।
লানা একটা আহত দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলল, কিন্তু কিছু বলল না। আমরা নিঃশব্দে আরো কয়েক পা হেঁটে গেলাম এবং লানা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে ব্যাগ থেকে একটা চতুষ্কোণ কার্ড বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আমার কার্ড।
আমি কার্ডটি হাতে নিলাম। মধ্যবিত্ত মানুষের স্বল্পমূল্যের কার্ড নয় এটি, রীতিমতো হলোগ্রাফিক মালটিকমিউনিকেশান্স কার্ড। বিজ্ঞানবিষয়ক সাপ্তাহিকীতে এর উপরে লেখা দেখেছি, কখনো নিজের চোখে দেখি নি। ছোট লাল বোতামে স্পর্শ করলে সাথে সাথে মেয়েটির সাথে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে যোগাযোগ করা যাবে। লানা বলল, আমি জানি তুমি প্রতিরক্ষাবাহিনীতে যোগ দিতে চাও না কিন্তু তবু যদি কোনো কারণে আমার সাথে যোগাযোগ করতে চাও এই কার্ডটি ব্যবহার কোরো।
কী নিয়ে যোগাযোগ করব?
লানা মিষ্টি করে হেসে বলল, সেটি তোমার ইচ্ছা। একটু থেমে বলল, আমি তা হলে আসি। তোমার সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগল।
ধন্যবাদ লানা।
লানা হেঁটে হেঁটে দূরে লেভিটেশান টার্মিনালে অদৃশ্য না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
রাত আরো গম্ভীর হয়েছে। আমার এখন বাসায় গিয়ে ঘুমানোর কথা, কিন্তু যে কারণেই হোক আমার বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না, আমি হেঁটে হেঁটে নিজেকে ক্লান্ত করে ফেলতে চাই। মাঝে মাঝে আমার বুকের ভিতরে গভীর এক ধরনের নিঃসঙ্গতা এসে ভর করে। কী করে সেই নিঃসঙ্গতা দূর করা যায় আমি জানি না। আমি তখন একা একা শহরের আনাচে–কানাচে হাঁটতে থাকি।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একসময় আমি আবিষ্কার করলাম আমি শহরের নির্জন পার্কের কাছে চলে এসেছি। ভিচুরিয়াসের নতুন একটি কম্পাউন্ড বের হবার পর থেকে শহরে ছোটখাটো অপরাধ খুব বেড়ে গেছে। নির্জন এলাকায় একটু পরে পরে দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউল বসানো হয়েছে, এতে অপরাধীদের ধরে শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারটি খুব সহজ হয়ে গেছে সত্যি কিন্তু অপরাধের সংখ্যা এতটুকু কমে নি। আমি এই নির্জন এলাকায় খ্যাপা কিছু ভিচুরিয়াসসেবীর হাতে ধরা পড়তে চাই না। পার্ক থেকে বের হবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই আমি দেখলাম একটু দূরে চার জন মানুষ এক সারিতে দাঁড়িয়ে আছে।
কৃত্রিম জ্যোৎস্নার নরম আলোতে মানুষগুলোকে এক ধরনের প্রেতাত্মার মতো দেখাতে থাকে। আমি বুকের ভিতরে এক ধরনের আতঙ্কের কাঁপুনি অনুভব করি। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কে?
মানুষগুলো কোনো উত্তর না দিয়ে এক পা এগিয়ে এল। আমি কাঁপা গলায় আবার জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কে? কী চাও?
চার জন মানুষের মাঝে অপেক্ষাকৃত খাটো মানুষটি মাটিতে থুতু ফেলে বলল, রোবটের বাচ্চা রোবট।
পানশালায় যে মানুষগুলো এসেছিল এরা নিশ্চয়ই তাদের দলের লোক। নিশ্চয়ই এরা প্রতিশোধ নিতে এসেছে। আমি কষ্ট করে নিজের গলার স্বর শান্ত রেখে বললাম, আমাকে যেতে দাও।
খাটো মানুষটি হিসহিস শব্দ করে বলল, তোমাকে নরকে যেতে দেব।
কী চাও তোমরা?
তোমার মুণ্ডু দিয়ে বল খেলতে চাই। চামড়া দিয়ে টেবিলক্লথ বানাতে চাই। রক্ত দিয়ে গ্রাফিতি আঁকতে চাই।
আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করতে থাকি এবং হঠাৎ করে আমার সমস্ত আতঙ্ক উবে গিয়ে সেখানে বিচিত্র এক ধরনের শক্তি এসে ভর করে। মনে হতে থাকে চোখের পলকে আমি চার জন মানুষকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারব। আমি কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রেখে বললাম, তোমরা কে আমি জানি না। আমার জানা প্রয়োজন নেই। ঠিক দশ সেকেন্ড সময় দিচ্ছি এর মাঝে—-
চুপ কর বেটা পিত্তথলি। সিফিলিসের ব্যাক্টেরিয়া।
খাটো চেহারার মানুষটা কথা শেষ করার আগেই একসাথে দুজন মানুষ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি প্রস্তুত ছিলাম, তারা আমার নাগালে আসার আগেই আমি শূন্যে লাফিয়ে উঠে সমস্ত শরীর ঘুরিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে দুজনকে লাথি দিয়ে নিচে ফেলে দিলাম। মানুষ দুজন নিচে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল, আমি তাদের দিকে নজর না দিয়ে বাকি দুজনের দিকে তাকালাম। শান্ত গলায় বললাম, দশ সেকেন্ড সময় দিয়েছিলাম, তার মাঝে দুই সেকেন্ড পার হয়ে গেছে আর আট সেকেন্ড