এক মুহূর্তের জন্য মনে হল মানুষ দুজন শেষ চেষ্টা করবে কিন্তু আমার কঠিন শান্ত ভঙ্গি দেখে শেষ পর্যন্ত করল না। অস্ত্র ফেলে হাত উঁচু করে দাঁড়াল। কিশোরী মেয়েটি সাথে সাথে নিজেকে মুক্ত করে আমার কাছে ছুটে আসে, আমার বুকের কাপড় ধরে হাউমাউ করে। কাঁদতে থাকে। আমি কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটির কোথাও বেকায়দা চাপ দিয়ে গুলি না করে ফেলি সেভাবে ধরে রেখে কিশোরী–মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, একটু সময় দাও আমাকে, নির্বোধ মানুষগুলোকে বেঁধে ফেলি।
আমার কথা শেষ হবার আগেই বেশ কয়েকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষ দুজনকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে হাত পিছনে বেঁধে ফেলতে শুরু করল।
আমি যখন আমার টেবিলে কোমের কাছে ফিরে গেলাম তখন পানশালার বেশিরভাগ মানুষ আমাকে ঘিরে রেখেছে। তাদের প্রায় সবারই ধারণা আমি সম্ভবত বিশেষ সামরিক অস্ত্রাগারে তৈরি একটি প্রতিরক্ষা রোবট। আমি মাথা নেড়ে সেটা অস্বীকার করার পরেও তারা সেটা বিশ্বাস করতে রাজি হল না।
কোম দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে বলল, আমি সবসময় তোমার সাথে ঠাট্টা করে বলে এসেছি যে তুমি একটি ক্লোন। আজকে আমি নিশ্চিত হলাম।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, কেন?
তুমি যে ক্ষিপ্রতায় খ্যাপা মেয়েটিকে আঘাত করেছ সেটি কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তুমি নিশ্চয়ই ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা একটা প্রাণী! তুমি নিশ্চয়ই ক্লোন।
ঠিক আছে কিন্তু আমি মানুষ সেটা তো স্বীকার করবে? নাকি তুমিও বিশ্বাস কর আমি একটা প্রতিরক্ষা রোবট?
কী জানি! কোম মাথা নেড়ে বলল, আমি আর কোনোকিছুই এখন বিশ্বাস করতে পারছি না।
.
আমি যখন পানশালা থেকে বের হলাম তখন মধ্যরাত্রি। কৃত্রিম জ্যোৎস্নার নরম আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কোথায় জানি পড়েছিলাম রাতের বেলায় মাইলারের পরদা দিয়ে মহাকাশ থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলন করিয়ে কৃত্রিম জ্যোৎস্না তৈরি করা নিয়ে একসময় পৃথিবীতে বড় ধরনের বিতর্ক হয়েছিল। কৃত্রিম জ্যোৎস্না সৃষ্টি করার আগে কৃষ্ণপক্ষে অমাবস্যা নামক একটি ব্যাপার ঘটত, তখন নাকি আলো না জ্বালিয়ে রাখলে সারা পৃথিবী গভীর অন্ধকারে ঢেকে যেত। ব্যাপারটি কীরকম আমরা এখন ভালো করে কল্পনাও করতে পারি না।
বাইরে বেশ ঠাণ্ডা, কনকন করে শীতের বাতাস বইছে। নিও পলিমারের পোশাকের উত্তাপ বাড়িয়ে দিতে এক ধরনের আলসেমি লাগছিল, আমি জ্যাকেটের কলার দুটি উঁচু করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিলাম।
আমি কি তোমার সাথে খানিকক্ষণ হাঁটতে পারি? গলার স্বর শুনে আমি চমকে উঠে মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। আমার পাশে পাশে হাঁটছে সোনালি চুলের একটি মেয়ে। মেয়েটিকে আমি পানশালায় দেখেছি, আরো কয়েকজন মানুষের সাথে এসেছিল। কৃত্রিম জ্যোৎস্নায় ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, মেয়েটির চোখ নীল, ত্বক কোমল এবং মসৃণ। মেয়েটি সম্ভবত সুন্দরী কিন্তু তবুও চেহারায় কোথায় জানি এক ধরনের কৃত্রিমতা রয়েছে–সেটি ঠিক ধরতে পারলাম না। আমি বললাম, অবশ্যই হাঁটতে পার। আগে থেকে বলে রাখছি হাঁটার সঙ্গী হিসেবে আমি কিন্তু একেবারে যাচ্ছেতাই।
তাতে কিছু আসে–যায় না। আজকে পানশালায় তুমি যেভাবে ঐ চরিত্রগুলোকে ধরেছ তার তুলনা নেই। আমি বাচ্চা মেয়ে হলে ডাইরিতে তোমার অটোগ্রাফ নিয়ে রাখতাম।
আমি হেসে বললাম, ওরকম পরিস্থিতিতে শরীরে এড্রিনেলিনের প্রবাহ বেড়ে যায় বলে অনেক কিছু করে ফেলা যায়।
মেয়েটা আমার গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমি প্রতিরক্ষাবাহিনীতে কাজ করি, কোনটা এড্রিনেলিনের প্রবাহ দিয়ে করা যায়, কোনটা করার জন্য অমানুষিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়–আমি খুব ভালো করে জানি।
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম। মেয়েটি বলল, আমার নাম লানা। আমি প্রতিরক্ষা দপ্তরে দ্বিতীয় কমান্ডিং অফিসার।
আমি লানা নামের মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকালাম। কমান্ডিং অফিসার কথাটি শুনলেই আমার চোখে উঁচু চোয়ালের ভাবলেশহীন একজন মানুষের চেহারা ভেসে ওঠে। সোনালি চুল, নীল চোখ আর কোমল ও নরম ত্বকের একটি মেয়েকে কেন জানি মোটেই কমান্ডিং অফিসার বলে মনে হয় না।
লানা ঘুরে আমার দিকে তাকাল, বলল, কী হল, পরিচয়টা বেশি পছন্দ হল না?
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, পছন্দ হবে না কেন? আমি তো আর গোপন ভিচুরিয়াস তৈরি করি না যে প্রতিরক্ষাবাহিনীর কমান্ডার শুনে আঁতকে উঠব!
কী কর তুমি?
বিশেষ কিছু করি না। একটা মাঝারি আকারের হলোগ্রাফিক ডাটা সেন্টার দেখাশোনা করি।
লানা শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বলল, কী বলছ তুমি! তোমার মতো একজন মানুষ ডাটা সেন্টার দেখাশোনা করে?
আমি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। যারা অনাথ আশ্রমে বড় হয় তাদের জীবনে বড় সুযোগগুলো কখনোই আসে না। মাঝারি এবং ছোট সুযোগগুলোও আমরা চোখে দেখি না। আমাদের পুরো জীবনটা কাটে বড় বড় বিপর্যয়কে পাশ কাটিয়ে।
লানা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি প্রতিরক্ষাবাহিনীতে ভালো করতে।
আমি অবাক হবার ভঙ্গি করে বললাম, কী বলছ তুমি? আমি জানতাম গায়ের জোর দিয়ে যুদ্ধ করত গুহা–মানবেরা! আজকাল মারপিট করা হয় যন্ত্র দিয়ে–রোবটেরা করে।
সেটা তুমি ঠিকই জান। কিন্তু একমূহূর্তের মাঝে অসম্ভব জটিল কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ভয়ঙ্কর কিছু কাজ করার ব্যাপারটি এখনো মানুষ ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। আর সেরকম মানুষ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই।