আছে। নিশ্চয়ই আছে। আমি ব্যাকুল হয়ে বললাম, আমি আছি।
আমরা জানি তুমি আছ। তোমার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ কিরি। অতিমানবীদের ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ জগতে তুমি আমাদের একমাত্র বন্ধু
যে মেয়েটি কথা বলছিল সে একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, মানুষের শরীরের সীমাবদ্ধতা আমাদের নেই। আমাদের দেহে অচিন্তনীয় শক্তি, পরিচিত রোগ–শোক আমাদের স্পর্শ করতে পারে না, অল্প একটু খাবারে আমরা দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারি, একটু অক্সিজেনেই আমাদের চলে যায়। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন থেকে বেঁচে থাকতে পারি, আমরা চিতাবাঘের চাইতেও ক্ষিপ্র, মত্ত হাতি থেকেও শক্তিশালী। তুমি একটু আগে আমাদের নতুন শক্তির সন্ধান দিয়েছ, মস্তিষ্কের সুষম উপস্থাপন করে এখন আমরা অন্যের মনকেও নিয়ন্ত্রণ। করতে পারি। এই পৃথিবীতে আমাদের বাধা দেবার কেউ নেই। আমরা ইচ্ছে করলে পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে অতিমানব জাতি সৃষ্টি করতে পারি।
আমি হতবাক হয়ে নয় জন অতিমানবীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটি আবার বলল, পৃথিবীতে মানবজাতির জন্য এর চেয়ে বড় আশঙ্কার ব্যাপার কিছু ঘটে নি।
কিন্তু
হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের প্রকৃত জিন মানুষ থেকে এসেছে। মানুষের জন্য আমাদের প্রকৃত ভালবাসা। মানুষকে রক্ষাও করব আমরা।
কী করবে তুমি? তোমরা?
আমরা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলব। শুধু নিজেদের নয়, এই ল্যাবরেটরিকে, এর প্রতিটি তথ্যকে।
না। আমি চিৎকার করে বললাম, না লাইনা।
আমাদের কোনো উপায় নেই কিরি।
তা হলে তোমরা কেন জেগে উঠে এসেছ?
তোমার জন্য। গ্রুটাসের নৃশংস থাবা থেকে তোমাকে উদ্ধার করে নিরাপদে এখান থেকে সরিয়ে দেবার জন্য। প্রতিরক্ষা দপ্তর যেন আর কখনো তোমাকে স্পর্শ না কতে পারে সেটি নিশ্চিত করার জন্য।
না। আমি কাতর গলায় বললাম, আমি যাব না। লাইনাকে না নিয়ে আমি যাব না।
নয় জন অতিমানবী কোমল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমি জানি না এর মাঝে কোনজন লাইনা। কিংবা কে জানে যখন নয় জন অবিকল ক্লোন তাদের মস্তিষ্কে অবিকল একই তথ্য নিয়ে থাকে তখন এই প্রশ্নটির আদৌ কোনো অর্থ আছে কি না। আমি তাদের মুখের দিকে তাকালাম, একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, তোমরা ইচ্ছে করলে আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন খুলে দেখতে পার। দেখ, তোমরা দেখ। আমার নিজের চেয়ে তোমরা বেশি জান আমি লাইনাকে ছাড়া থাকতে পারব না।
নয় জন অতিমানবী থেকে এক জন হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে এল, হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে, কোমল গলায় বলল, কিরি। আমি লাইনা।
লাইনা! আমি তাকে জাপটে ধরে বুকের মাঝে টেনে নিলাম। তার রেশমের মতো চুলে মুখ গুঁজে বললাম, লাইনা, সোনা আমার।
আমি আরো অনেক কথা বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু তার কিছুই বলতে পারলাম না, হঠাৎ এক ভয়াবহ শূন্যতায় আমার হৃদয়–মন হাহাকার করে ওঠে।
লাইনা মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। তার চোখে চিকচিক করছে পানি। দুই হাতে আমার মাথাকে ধরে নিজের মুখের কাছে টেনে এনে ফিসফিস করে বলল, কিরি, এই নয় জন অতিমানবীর মাঝে থেকেও আমি আলাদা। আমি একজন অতিমানবী যে তোমার আসল ভালবাসাটুকু পেয়েছি। সেই ভালবাসা আমি অন্যদের মাঝে সঞ্চারিত করেছি। আমাদের এই ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ জীবনে তোমার ভালবাসাটুকু একমাত্র সুখের স্মৃতি।
আমি লাইনার অনিন্দ্যসুন্দর মুখমণ্ডলে হাত দিয়ে স্পর্শ করে কাতর গলায় বললাম, লাইনা, তুমি যেও না। তুমি আমার সাথে চল।।
না কিরি। লাইনা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, তুমি আমাকে এ কথা বোলো না, আমার শেষ সময়টুকু তুমি আরো কঠিন করে দিও না।
আমি ভাঙা গলায় বললাম, লাইনা, সোনা আমার! তুমি চল আমার সাথে। দূর নির্জন এক দ্বীপে শুধু তুমি আর আমি থাকব। পৃথিবীর মানুষ জানবে না। শুধু তুমি আর আমি। তুমি আর আমি।
লাইনা হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল, আমাকে এভাবে বোলো না। এভাবে লোভ দেখিও না কিরি। আমাকে স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখিও না।
তা হলে আমি কী নিয়ে থাকব?
লাইনা আমাকে গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করে বলল, আমার চোখের দিকে তাকাও কিরি।
আমি লাইনার চোখের দিকে তাকালাম। লাইনা ফিসফিস করে বলল, তোমার সব দুঃখ আমি ভুলিয়ে দেব কিরি। আমাকে নিয়ে তোমার সব স্মৃতি আমি মুছে দেব।
না। আমি ভুলতে চাই না। আমি চিৎকার করে বললাম, আমি ভুলতে চাই না।
তোমাকে ভুলতে হবে কিরি। আমি একজন অতিমানবী–অতিমানবীর স্মৃতি তুমি নিজের মাঝে রেখো না।
না। লাইনা। না—
আমার চোখের দিকে তাকাও কিরি।
আমি লাইনার চোখের দিকে তাকালাম। কী অপূর্ব আয়ত কালো দুটি চোখ–সেই চোখে চিকচিক করছে পানি। চোখের মাঝে কী বিস্ময়কর গভীরতা! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি, তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটি গভীর বেদনায় আমার বুক দুমড়ে–মুচড়ে যেতে থাকে। সেই অপূর্ব কালো গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার মনে হতে থাকে আমি বুঝি সেই চোখের গভীরে প্রবেশ করে যাচ্ছি। মনে হতে থাকে সেই গভীরে এক বিশাল শূন্যতা। মনে হয় আদি নেই, অন্ত নেই এক বিশাল বেলাভূমিতে আমি দাঁড়িয়ে আছি, সমুদ্রের কল–কল্লোল ভেসে আসছে দূর থেকে। নীল মহাসমুদ্রের ঢেউ ভেসে এসে একের পর এক আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে, সিক্ত হয়ে যাচ্ছে আমার পা। আমি মাথা তুলে তাকালাম, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লাইনা, বাতাসে উড়ছে তার দেহের অর্ধস্বচ্ছ কাপড়। আমি ম বালুতে পা ফেলে এগিয়ে গেলাম লাইনার দিকে, লাইনা তখন সরে গেল আরো দূরে। আমি আবার এগিয়ে গেলাম–লাইনা তখন আরো দূরে সরে গেল। আমি আবার এগিয়ে গেলাম, লাইনা তখন আরো দূরে সরে গেল। আমি তাকিয়ে রইলাম, দেখতে পেলাম লাইনা চলে যাচ্ছে দূরে…..বহুদূরে, আমি তাকে ধরতে পারছি না। দূরদিগন্তে সে মিশে যাচ্ছে মিলিয়ে যাচ্ছে চিরদিনের জন্য। বালুবেলায় আমি হাঁটু ভেঙে পড়ে যাচ্ছি। সমুদ্রের পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাকে। ঢেউয়ের পর ঢেউ আসছে। এক গভীর শূন্যতায় আমি হারিয়ে যাচ্ছি, এক ভয়াবহ নিঃসঙ্গতায় আমি ডুবে যাচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছি এক অন্ধকারে–এক নির্জনতায়–এক নিসঙ্গতায়…