বল।
তুমি কি নিজেকে মানুষ বলে দাবি কর?
দুর্ভাগ্যক্রমে করি। আমার ক্রমোজম ৪৬টি।
মানুষের একটি সংজ্ঞা আছে গ্রুটাস। সেটি হচ্ছে পরস্পর পরস্পরের জন্য ভালবাসা। তোমার মাঝে তার এতটুকুও নেই।
অপ্রয়োজনীয় অনুভূতি কোনো কাজে আসে না।
তুমি মানুষ নও গ্রুটাস। তুমি পশুও নও। তুমি একটি তুচ্ছ কলকব্জা। তুচ্ছ যুক্তিতর্ক। তুচ্ছ নিয়মকানুন। এই পৃথিবীতে তোমার কোনো প্রয়োজন নেই।
সেটি ব্যক্তিগত বিশ্বাস–অবিশ্বাসের ব্যাপার।
তোমার এই তুচ্ছ জীবনকে আমি শেষ করে দেব গ্রুটাস। আমি তোমাকে হত্যা করতে এসেছি।
আমারও তাই ধারণা। গ্রুটাস ভেসে ভেসে খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, তুমি চেষ্টা করে দেখতে পার।
আমি আমার হাতটি উদ্যত করতে গিয়ে থেমে গেলাম, গ্রুটাস হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল। এই প্রথম আমি এ প্রাণীটিকে হাসতে দেখলাম। গ্রুটাস হাসতে হাসতে বলল, তুমি প্রথমবার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছ, আমরা সেটা থামাতে পারি নি। দ্বিতীয়বারও পারি নি তার অর্থ এই নয় যে, আমি তোমাকে তৃতীয়বার এখানে বিস্ফোরণ ঘটাতে দেব।
গ্রুটাস হঠাৎ সরসর করে আমার একেবারে কাছে এসে হাজির হল, আমি তার হলুদ চোখ, চোখের ফুলে ওঠা রক্তনালী পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পেলাম। সে ষড়যন্ত্রীদের মতো নিচু গলায় বলল, এই মুহূর্তে ঘরের চারপাশে চারটি প্রতিরক্ষা ডিভাইস তোমার হাতের মাঝে লুকানো বিস্ফোরকটিকে লক ইন করে আছে। তোমার হাত যদি এক সেন্টিমিটার উপরে ওঠাও চারটি এক শ মেগাওয়াটের আই. আর. লেজার তোমাকে ভস্মীভূত করে দেবে।
গ্রুটাস ভেসে ভেসে আমার আরো কাছে চলে এল, আমি তার কুঞ্চিত চামড়া, চুলহীন বীভৎস মাথা, মাথার ভিতরে নড়তে থাকা যন্ত্রাংশ স্পষ্ট দেখতে পেলাম, কটু গন্ধে হঠাৎ আমার সারা শরীর গুলিয়ে এল। গ্রুটাস প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস না করলে তুমি চেষ্টা করে দেখতে পার। আমি তোমার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছি কিরি। আমি শুনেছি তুমি নাকি চিতাবাঘের চাইতেও ক্ষিপ্র।
আমি এতটুকু না নড়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বিকৃত দেহের এই মানুষটার প্রতি একটা অচিন্তনীয় ঘৃণা আমার ভিতরে পাক খেতে থাকে, ভয়ঙ্কর বিজাতীয় একটা ক্রোধ এবং আক্রোশ আমার সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে থাকে। ইচ্ছে করতে থাকে সত্যি সত্যি আমি চিতাবাঘের মতো এই কুৎসিত প্রাণীটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। টুটি চেপে ধরে তার বীভৎস মস্তিষ্ক মেঝেতে ঠুকে ঠুকে ভিতর থেকে থলথলে ঘিলুটাকে বের করে আনি।
কিরি তুমি শান্ত হও। আমি চমকে উঠলাম, কে আমার মস্তিষ্কের মাঝে কথা বলছে?
তুমি নিজেকে সংবরণ কর কিরি।
কে কথা বলছে? আমার মাথা থেকে তো ট্র্যালিওশান সরিয়ে নিয়েছে। এখন তো আর কিছুই সরাসরি আমার মস্তিষ্কে কথা বলতে পারবে না। কে কথা বলছে? তা হলে কি অতিমানবীরা নিজেদের মুক্ত করে চলে এসেছে?
দরজায় একটা মৃদু শব্দ হল এবং আমি মাথা ঘুরে তাকালাম, দেখতে পেলাম ধীর পদক্ষেপে এক জন এক জন করে নয় জন অতিমানবী ঘরে এসে ঢুকছে। তাদের মুখমণ্ডল শান্ত, সেখানে এক ধরনের স্নিগ্ধ কোমলতা।
কিরি, নিজেকে শান্ত কর। আমি আবার শুনতে পেলাম কেউ একজন বলল, আমি লাইনা।
লাইনা! আমি আনন্দে চিৎকার করতে গিয়ে থেমে গেলাম, এই ঘরে চারটি এক শ মেগাওয়াট আই. আর. লেজার আমার দিকে তাক করা আছে, ইচ্ছে করলেই আমাদের ভস্মীভূত করে দেবে।
নয় জন অতিমানবী খুব শান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে হেঁটে আমার দুপাশে এসে দাঁড়াল। আমি কাঁপা গলায় বললাম, খুব সাবধান। চারটি আই. আর. লেজার–
কোনো ভয় নেই। ঠিক আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অতিমানবীটি বলল, গ্রুটাসের মস্তিষ্ক এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে। তুমি সত্যি কথাই বলেছিলে কিরি। আমরা নয় জন যখন আমাদের মস্তিষ্কের সুষম উপস্থাপন করি ভয়ঙ্কর রেজোনেন্স হয় তখন যা ইচ্ছে করতে পারি আমরা।
তোমরা সত্যিই গ্রুটাসকে নিয়ন্ত্রণ করছ? সত্যি?
হ্যাঁ। শুধু গ্রুটাস নয়, এই ল্যাবরেটরির সকল জীবিত প্রাণীকে নিয়ন্ত্রণ করছি। ইচ্ছে করলে তোমাকেও করতে পারি, কিন্তু তার তো কোনো প্রয়োজন নেই।
আমি হেসে বললাম, না, আমি যেটুকু জানি তাতে মনে হয় প্রয়োজন নেই।
তোমার ধারণা সত্যি কিরি। আমরা সবাই মিলে একটা অস্তিত্ব সেটি আমরা জানতাম কিন্তু আমাদের সবার মস্তিষ্ক যে একসাথে সুষম উপস্থাপন করতে পারে আমরা সেটা জানতাম না। এখন আমরা সেটা করছি। আমাদের এখন কী ভয়ঙ্কর শক্তি তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।
আমি জানি। আমি অনুভব করতে পারছি।
আমরা ইচ্ছে করলে পৃথিবীর যে কোনো জীবিত প্রাণীর মস্তিষ্কে প্রবেশ করে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সেটাকে পরিবর্তন করতে পারি। মস্তিষ্কের নিউরন থেকে তথ্য মুছে দিতে পারি, সিনান্সের জোড় খুলে দিতে পারি। ইচ্ছে করলে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন থামিয়ে দিতে পারি, ফুসফুসকে নিথর করে দিতে পারি। আমরা যদি চাই এই মুহূর্তে গ্রুটাসকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারি।
আমি জানি।
আমরা অতিমানবী। কিন্তু এই পৃথিবী, পৃথিবীর সভ্যতা অতিমানবীর জন্য তৈরি হয় নি। আমরা এখানে অনাহুত। মা–বাবার ভালবাসায় আমরা জন্ম নিই নি, মা–বাবার ভালবাসায় বড় হই নি। কিন্তু মা–বাবার ভালবাসায় সিক্ত হওয়া সেই জিন আমাদের মাঝে রয়ে গেছে। আমরা ভালবাসার জন্য, স্নেহের জন্য কাঙাল–একটি কোমল কথার জন্য তৃষ্ণার্ত, কিন্তু সমস্ত পৃথিবীতে আমরা বড় নিঃসঙ্গ। আমাদেরকে এতটুকু স্নেহ দেবার জন্য কেউ নেই।