আমি রোবটটিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে চিৎকার করে বললাম, আমার হাতের মাঝে যে পরিমাণ বিস্ফোরক রয়েছে সেটা ব্যবহার করে আমি ইচ্ছা করলে এ রকম দুই চারটে ল্যাবরেটরি উড়িয়ে দিতে পারি। একটু আগে আমি রেট্রো ভাইরাস ল্যাবরেটরিটা উড়িয়ে দিয়ে এসেছি, তোমরা হয়তো সেটা এখানে বসে টের পেয়ে থাকবে।
রোবটটি যান্ত্রিক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, পেয়েছি।
আমার কথা না শুনলে আমি এই মুহূর্তে তোমাদের ধ্বংস করে দেব।
রোবটের মতো দেখতে একজন মানুষ এগিয়ে এসে শুষ্ক গলায় বলল, তুমি কী চাও?
এই ক্রায়োজেনিক পাম্প বন্ধ করে অতিমানবীদের দেহ উষ্ণ করে তোল। আমি তাদের সাথে কথা বলতে চাই।
সেটি সম্ভব নয়।
সেটি সম্ভব করতে হবে।
রোবটের মতো দেখতে মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, সেটি কিছুতেই সম্ভব নয়।
আমি আমার হাতটি ক্রায়োজেনিক পাম্পের দিকে লক্ষ্য করে মাংসপেশি ব্যবহার করে একটি ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটালাম। হাতের যে অংশটি দিয়ে ক্ষুদ্র কিন্তু শক্তিশালী বিস্ফোরকটি বের হয়ে এসেছে সেখান থেকে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছিল, আমি সাবধানে সেটা চেপে ধরে রেখে উপরের দিকে তাকালাম, একটু আগে যেখানে একটি বিশাল ক্রায়োজেনিক পাম্প ছিল এখন সেখানে একটি বিশাল গর্ত। সারা ঘরে বিস্ফোরণের ধ্বংসপ্প ছড়িয়ে পড়ছে। আমি রোবটের মতো মানুষটির দিকে তাকিয়ে বললাম, এখন কি সম্ভব হয়েছে?
মানুষটি তার উপর থেকে ধুলোবালি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, হ্যাঁ। সম্ভব হয়েছে। অতিমানবীদের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করবে এক্ষুনি।
আমি তাদের সাথে কথা বলতে চাই।
তারা স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছে। তোমার কথা শুনবে না।
আমি তবু কথা বলতে চাই।
সেটি সম্ভব নয়।
আমি আমার হাত উদ্যত করে বললাম, আমার হাতে এখনো আরো একটি বিস্ফোরক রয়েছে।
মানুষটি হঠাৎ দ্রুত কাছাকাছি একটা ক্যাপসুলের পাশে রাখা একটি মাইক্রোফোন। আমার হাতে তুলে দিল। বলল, তুমিই চেষ্টা কর।
আমি মাইক্রোফোনটি হাতে নিয়ে ডাকলাম, লাইনা, তুমি কোনজন?
সারি সারি রাখা নয়টি ক্যাপসুলে নয়টি অতিমানবীর শীতল দেহ, তার মাঝে কোনোটি সাড়া দিল না। আমি আবার বললাম, আমি জানি তুমি আমার কথা শুনছ। তুমি সাড়া দাও লাইনা।
কেউ সাড়া দিল না। আমি কাতর গলায় বললাম, লাইনা, আমি ক্রায়োজেনিক পাম্পটি ধ্বংস করে দিয়েছি। আমি জানি তোমাদের দেহ ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়ে উঠছে। তোমাদের জেগে উঠতে হবে লাইনা। তোমাদের বেঁচে উঠতে হবে। তোমাদের ওপর যে ভয়ঙ্কর অবিচার করা হয়েছে তার প্রতিকার না করে তোমরা চলে যেতে পারবে না। কিছুতেই চলে যেতে পারবে না।
নয়টি ক্যাপসুলে নয় জন অতিমানবী নিথর হয়ে শুয়ে রইল। আমি একটি একটি করে সব কয়টি ক্যাপসুলের সামনে দাঁড়ালাম, কোনোটির মাঝে এতটুকু প্রাণের চিহ্ন নেই। মাইক্রোফোন হাতে আমি চিৎকার করে উঠলাম, লাইনা, সোনা আমার। জেগে ওঠ। দোহাই তোমার–জেগে ওঠ।
কেউ জেগে উঠল না। আমি ভাঙা গলায় বললাম, তোমরা নয় জন অতিমানবী, তোমাদের মস্তিষ্ক হবহু এক পর্যায়ে, তোমাদের প্রত্যেকের প্রতিটি নিউরন একরকম, তার মাঝে তথ্য একরকম। প্রতিটি সিনান্স একইভাবে জুড়ে আছে–সারা পৃথিবীতে এর থেকে বড় সুষম উপস্থাপন কি আর কোথাও আছে? নেই! একটিও নেই! তোমরা ইচ্ছে করলে অসাধ্য সাধন করতে পার। নয় জন একসাথে যদি তোমাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক তরঙ্গকে উজ্জীবিত কর, কী ভয়ঙ্কর রেজোনেন্স হবে তোমরা জান? একটিবার চেষ্টা করে দেখ–মাত্র একটিবার! ইচ্ছে করলে তোমরা সারা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করতে পার। তা হলে কেন এত বড় একটা অবিচার সহ্য করে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছ? কেন?
আমি ক্যাপসুলগুলোর মাঝে খ্যাপার মতো ঘুরে বেড়ালাম। তাদের ঢাকনা টেনে খোলার চেষ্টা করলাম। ক্যাপসুলগুলো ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে নাড়ানোর চেষ্টা করলাম, মুখ লাগিয়ে চিৎকার করে কথা বলার চেষ্টা করলাম, কোনো লাভ হল না। আমি বুকের ভিতরে এক ভয়াবহ শূন্যতা অনুভব করতে থাকি, ইচ্ছে হতে থাকে ক্যাপসুলে মাথা কুটে আকুল হয়ে কঁদি, কিন্তু আমি তার কিছুই করলাম না। ঘরে অসংখ্য রোবট এবং রোবটের মতো মানুষ আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তাদের সামনে ব্যথাটুকু প্রকাশ করতে আমার সংকোচ হল।
আমি একসময় চোখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। এই ভয়ঙ্কর অবিচারের প্রতিশোধ আমার একাই নিতে হবে। আমার হাতে এখনো দ্বিতীয় বিস্ফোরকটি রয়ে গেছে, সেটি দিয়েই আমি গ্রুটাসকে হত্যা করব। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি চিৎকার করে বলব, তুমি একজন দানব। পৃথিবীর বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে তাকে তুমি কলুষিত করতে পারবে না। তারপর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে আমি তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেব। তার কুৎসিত দেহ, বীভৎস মস্তিষ্ক আমি চূর্ণ করে দেব।
আমি শেষবার একবার কালো স্টেনলেস স্টিলের ক্যাপসুলে হাত বুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। ল্যাবরেটরিতে এখনো আধা–মানুষ আধা–যন্ত্র বিচিত্র প্রাণীরা ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে, আমাকে দেখে সেগুলো ভয়ে ছিটকে সরে গেল। আমি পাথরের মতো মুখ করে সোজা হেঁটে গেলাম গ্রুটাসের সাথে শেষ বোঝাপড়া করতে।
.
গ্রুটাসকে দেখে মনে হল সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ঘরের মাঝামাঝি সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেও সে একটি কথাও বলল না। আমি কঠোর গলায় বললাম, গ্রুটাস।