লাইনার দ্বিতীয় সত্তাকে সাথে নিয়ে আমরা শহরের বাইরের একটি নির্জন পাহাড় থেকে তৃতীয় সত্তাকে তুলে নিলাম। আমরা যখন তাকে তুলতে গিয়েছি সে তখন প্রস্তুত হয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এবারেও ঠিক আগের মতো একজন আরেকজনকে ধরে একাগ্র দৃষ্টিতে চোখের দিকে তাকিয়ে একে অপরকে বুঝে নিতে শুরু করল।
এভাবে এক জন এক জন করে নয় জনকে ভাসমান যানে তুলে নিলাম। তারা সবাই একই ধরনের ক্লোন, তাদের চেহারা হুবহু একই রকম, শুধু তাই নয়, তারা সবাই একই পোশাক পরে আছে। তারা দীর্ঘসময় আলাদা হয়ে ছিল, দেখা হবার পর নিজেরা নিজেদের সাথে কথাবার্তা বলবে বলে আমার যে ধারণা ছিল সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে, কারণ আমি জানতাম না লাইনারা নিজেদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য কথা বলতে হয় না, বিচিত্র একটি উপায়ে তারা মস্তিষ্কের ভিতরে কথা বলতে থাকে। লাইনাকে তার মৃত্যুর সীমানা থেকে টেনে আনার সময় সে আমার সাথে একবার কথা বলেছিল। ব্যাপারটি কীভাবে করে কে জানে, সুযোগ পেলে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। আমি ভাসমান যানে বসে দেখতে পাচ্ছি নয় জন লাইনা পাশাপাশি বসে আছে, কেউ কারো দিকে তাকিয়ে নেই কিন্তু তাদের মুখভঙ্গি একই রকম, সবারই একসাথে হাসিমুখ হয়ে আবার একই সাথে গাঢ় বিষাদে ঢেকে যাচ্ছে, সবাই একই সাথে একই জিনিস ভাবছে তারা আলাদা মানুষ হয়েও তাদের মস্তিষ্ক একটি। না জানি এই মস্তিষ্কের মাঝে কী ভয়ানক ক্ষমতা লুকিয়ে আছে।
ভাসমান যানটি আমাদেরকে প্রজেক্ট অতিমানবীর ল্যাবরেটরির ভিতরে নামিয়ে দিয়ে উড়ে চলে গেল। ভাসমান যানটির লাল বাতিটি পুরোপুরি অদৃশ্য না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। আমরা এখন এই দেয়ালে ঘেরা ল্যাবরেটরিতে পুরোপুরি প্রতিরক্ষাহীন। বলা যেতে পারে পুরোপুরি গ্রুটাসের অনুকম্পার ওপরে নির্ভর করে আছি। আমি বুকের ভিতর এক ধরনের অশুভ আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি, বাইরে সেটা প্রকাশ না করে আমি নিচু গলায় বললাম, চল ভিতরে যাওয়া যাক।
আমার মস্তিষ্কের মাঝে কেউ একজন মৃদু স্বরে বলল, তুমি ভয় পেয়ো না কিরি। ভয়ের কিছু নেই।
আমি চমকে উঠে নয় জন লাইনার দিকে তাকালাম, তাদের মাঝে কে কথাটি বলেছে বুঝতে পারলাম না। আমার মনেই ছিল না এই নয় জন অতিমানবী, আমার মস্তিষ্কের মাঝে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াতে পারে।
ল্যাবরেটরির দরজার কাছে পৌঁছানো মাত্রই আবার চতুষ্কোণ দরজাটি খুলে গেল। প্রথমে আমি এবং আমার পিছু পিছু বাকি নয় জন ভিতরে এসে ঢুকল। আজকে দরজার পাশে চার হাতের সেই মানুষটি দাঁড়িয়ে নেই, যে দাঁড়িয়ে আছে সে আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক এবং নিরস্ত্র। মানুষটি উঁচু গলায় বলল, তোমাদের জন্য মহামান্য গ্রুটাস অপেক্ষা করছেন।
আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। মানুষটি হাঁটতে শুরু করল এবং আমরা দশ জন তার পিছু পিছু যেতে শুরু করলাম। আমি হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে একবার নয় জন অতিমানবীর মুখের দিকে তাকালাম, তাদের চেহারায় আতঙ্ক বা অস্থিরতার কোনো চিহ্ন নেই, বরং এক বিস্ময়কর প্রশান্তি। এদের মাঝে কোনজন লাইনা কে জানে, কিংবা কে জানে এই প্রশ্নটিই কি এখন করা সম্ভব?
হ্যাঁ সম্ভব। আমার মাথার মাঝে লাইনা বলল, শুধু আমাকে একটি নাম দিয়েছ তুমি, এখানে আর কারো নাম নেই।
আমি আবার ঘুরে তাকালাম এবং লাইনা এবারে হাত তুলে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। সে নিজে থেকে পরিচয় না দিলে এই নয় জনের ভিতর কোনজন লাইনা আমার পক্ষে বোঝা সেটি একেবারেই অসম্ভব। আমি লাইনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কীভাবে এটি কর? ব্যাপারটি প্রায় ভৌতিক।
লাইনা এবারে শব্দ করে হেসে বলল, মানুষ যেটা বুঝতে পারে না সেটাকেই বলে ভৌতিক। এটি অত্যন্ত সহজ একটি ব্যাপার। দুটি মস্তিষ্কের স্টেট পুরোপুরি এক হলে তার স্বাভাবিক কম্পন এক হয়ে যায় তখন খুব সহজে সুষম উপস্থাপন করা যায়। আমরা নিজেরা সেটা করি অনায়াসে, তোমারটাতে একটু অসুবিধে হয়
কিন্তু যেহেতু এটা তথ্যের এক ধরনের আদান-প্রদান, এর বিনিময় হয় কিসে?
সবই বিদ্যুৎ চৌম্বকীয়। মানুষের শরীরে নার্ভাস সিস্টেমের সমস্ত তথ্যের আদান প্রদান হয় ইলেকট্রো কেমিক্যাল সিগনাল দিয়ে।
ব্যাপারটি বোঝার জন্য আমি আরো একটা প্রশ্ন করতে চাইছিলাম কিন্তু তার আগেই যে মানুষটি পথ দেখিয়ে আনছে সে একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এখানে মহামান্য গ্রুটাস তোমাদের সাথে দেখা করবেন।
আমি একটু অবাক হয়ে ঘরটিতে প্রবেশ করলাম। আমার পিছু পিছু লাইনারা নয় জন এবং সবার শেষে মানুষটি নিজেও ভিতরে ঢুকে গেল। ঘরটি ছোট এবং সেখানে গ্রুটাস নেই, আমি যেভাবে গ্রুটাসকে দেখেছি সে এখানে কীভাবে আসবে বুঝতে পারলাম না। আমি ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করছিলাম ঠিক তখন ঘরঘর শব্দ করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ ঘরের ভিতরে একটা অত্যন্ত বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে শুরু করল। কোনো একটা জিনিস ফেটে যাবার মতো শব্দ করে আমাদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি বাতাস বের হয়ে যাওয়া বেলুনের মতো শব্দ করে চুপসে যেতে শুরু করল। আমি অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম এটি সত্যিকার মানুষ নয়। আমার সামনে মানুষটি দুমড়েমুচড়ে ভেঙেচুরে যেতে শুরু করল এবং হঠাৎ করে আমার নাকে তীব্র একটি ঝাজালো গন্ধ এসে লাগল। গন্ধটি অপরিচিত, এটি বিষাক্ত কোনো গ্যাস, মানুষের মতো দেখতে এই যন্ত্রটির ভিতরে করে পাঠানো হয়েছে। আমার চেতনা হঠাৎ করে লুপ্ত হয়ে যেতে শুরু করে, জ্ঞান হারানোর আগে আমি ঘুরে তাকালাম—অতিমানবীরাও বুক চেপে ধরে দেয়াল আঁকড়ে ধরে কোনোভাবে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। এটি শুধু মানুষের জন্য বিষাক্ত নয়, অতিমানবীদের জন্যও বিষাক্ত। আমরা একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে পা দিয়েছি।