খনির নিচে অন্ধকার সুড়ঙ্গের বাতি জ্বালিয়ে আমি নির্দিষ্ট পথে যেতে থাকি, বড় বড় দুটি গুহার মতো অংশ পার হয়ে একটি সরু সুড়ঙ্গের পরেই আমি ক্ষীণ আলোকরশ্মি দেখতে পেলাম। ফাঁকা জায়গাটাতে পৌঁছে আমি ডাকলাম, লাইনা, তুমি কোথায়?
আমার কথার কেউ উত্তর দিল না। হঠাৎ আমার বুকের ভিতর একটা আশঙ্কা উঁকি দিয়ে গেল, ভয় পাওয়া গলায় আবার ডাকলাম, লাইনা, তুমি কোথায়?
ঠিক তখন আমি লাইনাকে দেখতে পেলাম, শক্ত পাথরের মেঝেতে নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে। আমি ছুটে গিয়ে তার উপর ঝুঁকে পড়লাম, আবার ডাকলাম, লাইনা।
লাইনা খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল, তার দৃষ্টি দেখে আমি হঠাৎ শিউরে উঠলাম, কী ভয়ঙ্কর শূন্যতা সেখানে। আমি কাঁপা গলায় বললাম, কী হয়েছে তোমার?
লাইনা ফিসফিস করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল আমি ঠিক শুনতে পেলাম না। আমি তার হাত ধরে তার আরো কাছে ঝুঁকে পড়লাম, হাতটি বরফের মতো শীতল। লাইনা ফিসফিস করে বলল, বিদায়।
আমি প্রায় আর্তনাদ করে কাতর গলায় বললাম, কী হয়েছে তোমার লাইনা?
লাইনা দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে চোখ বন্ধ করল। আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম সে আত্মহত্যা করতে শুরু করেছে। আমাকে বলেছিল যখন সে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেবে তার দেহ নিজে থেকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে–স্বেচ্ছামৃত্যু! সত্যিই কি সেটা হতে চলেছে?
আমি পাগলের মতো লাইনাকে জাপটে ধরে ঝাঁকুনি দিতে থাকি, চিৎকার করে ডাকতে থাকি, লাইনা লাইনা, তুমি যেও না, যেও না।
লাইনা অনেক কষ্টে চোখ খুলে তাকিয়ে শোনা যায় না এ রকম স্বরে বলল, আমি ভেবেছিলাম তুমি আর আসবে না।
এই তো এসেছি। তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
দেরি হয়ে গেছে কিরি। লাইনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, বিদায়।
না। আমি চিৎকার করে বললাম, তুমি এটা করতে পার না। তুমি যেতে পারবে।
লাইনার নিশ্বাস আর স্পন্দন আরো বিলম্বিত হতে থাকে। শরীর শীতল হয়ে আসছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠতে শুরু করেছে। আমি লাইনাকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চিৎকার করে বললাম, তুমি যেতে পারবে না লাইনা। যেতে পারবে না। আমি তোমার জন্য প্রতিরক্ষা দপ্তরে গিয়েছি, গ্রুটাসের মুখোমুখি হয়েছি, আমি নিজের জীবন পণ করেছি শুধু তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য। তুমি এভাবে যেতে পারবে না। পারবে না।
লাইনার শরীর আরো নির্জীব হয়ে ওঠে। তার অনিন্দ্যসুন্দর মুখাবয়বে কেমন জানি এক ধরনের শীতলতার ছাপ এসে পড়েছে। মাথায় এলোমেলো ঘন কালো চুলের মাঝে নিখুঁত মুখাবয়ব ফুটে রয়েছে। ভরাট টুকটুকে লাল দুটি ঠোঁট অল্প ফাঁক করে রেখেছে, মুক্তার মতো ঝকঝকে দাঁত দেখা যাচ্ছে সেই ফাঁক দিয়ে। বড় বড় বিস্ময়কর চোখ দুটি বুজে আছে। আমার মনে হতে থাকে এই চোখ দুটি খুলে আমার দিকে আরো একবার না তাকালে আমি আর বেঁচে থাকতে পারব না। এক সম্পূর্ণ অপরিচিত অনুভূতি আমার বুককে গুঁড়িয়ে দিতে থাকে। আমার সমস্ত হৃদয় এক ভয়াবহ শূন্যতায় ঢেকে যেতে থাকে। আমি নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না। লাইনাকে টেনে তুলে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো হু হু করে কেঁদে উঠলাম। তার মাথায় হাত বুলিয়ে ভাঙা গলায় বললাম, না লাইনা, তুমি এটা করতে পারবে না। আমাকে ছেড়ে তুমি যেতে পারবে না। পারবে না। আমি তা হলে কাকে নিয়ে থাকব?
আমি কতক্ষণ এভাবে লাইনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলাম জানি না। তার মাথায় মুখ ঘষে আমি অপ্রকৃতিস্থের মতো কাঁদছি ঠিক তখন আমার মস্তিষ্কে একজন ডাকল, কিরি।
আমি চমকে উঠলাম, কে কথা বলছে? এটা কি আমার ট্রাকিওশান ইশি?
না, কিরি। আমি লাইনা।
লাইনা! আমি চমকে উঠলাম, কেমন করে সে আমার মস্তিষ্কে কথা বলছে?
আমি পারি কিরি। আমি অতিমানবী। আমি চলে যেতে যেতে ফিরে এসেছি কিরি। আমি তোমার জন্য ফিরে এসেছি। আমি বড় দুঃখী। আমি বড় একাকী, বড় নিঃসঙ্গ। আমি বড় ভালবাসার কাঙাল। বল, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না। বল। কথা দাও।
আমি লাইনার শীতল দেহকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, তার চুলে মুখ ডুবিয়ে কাতর গলায় বললাম, কথা দিচ্ছি লাইনা। কথা দিচ্ছি। আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব না। কখনো যাব না। তুমি ফিরে এস আমার কাছে।
আমি হঠাৎ অনুভব করতে পারি লাইনার দেহে আবার উষ্ণতা ফিরে আসছে। জীবনের উষ্ণতা। প্রাণের উষ্ণতা। আমার সমস্ত দেহ–মন এক বিচিত্র অনুভূতিতে অভিভূত হয়ে ওঠে, একেই কি ভালবাসা বলে?
.
ভাসমান যানে লাইনাকে নিয়ে পাশের শহরে সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলের একটি পরিত্যক্ত এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের সামনে দাঁড়ালাম। বিল্ডিঙের দু শ এগার তলার বিধ্বস্ত একটি ঘরের সামনে দাঁড়াতেই দরজা খুলে একটি মেয়ে বের হয়ে এল। মনে হল মেয়েটি আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। মেয়েটি দেখতে হুবহু লাইনার মতো, আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত না থাকলে নিশ্চিতভাবে ধরে নিতাম ঘরের ভিতর থেকে লাইনাই বের হয়ে এসেছে। মেয়েটি এসে লাইনার সামনে দাঁড়াল, একজন আরেকজনকে আঁকড়ে ধরে চোখে চোখে তাকিয়ে রইল, তাদের মুখে অনুভূতির কোনো চিহ্ন ফুটে উঠল না, শুধু মনে হল অসম্ভব একাগ্রতায় কিছু একটা বুঝে নিতে চেষ্টা করছে। মানুষের চোখ আসলে মস্তিষ্কের একটা অংশ, চোখে চোখে তাকিয়ে আমরা তাই অনেক কিছু বুঝে ফেলতে পারি। লাইনা এবং তার এই সত্তাটি অতিমানবী, তারা নিশ্চয়ই চোখে চোখে তাকিয়ে তাদের এই দীর্ঘ সময়ের সব না–বলা কথা বলে নিচ্ছে, অবরুদ্ধ আবেগের বিনিময় করছে। কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে তারা একজন আরেকজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এবং আমি প্রথমবার বুঝতে পারি লাইনা ঠিকই বলেছে আলাদাভাবে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই, সবাইকে নিয়েই তাদের পরিপূর্ণ জীবন।