তোমরা এখন তা হলে কী করবে?
আমরা নিজেদেরকে ধ্বংস করে ফেলব।
ধ্বংস করে ফেলবে? আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে আত্মহত্যা করবে?
হ্যাঁ।
কীভাবে?
মেয়েটি কোমল ভঙ্গিতে হেসে বলল, আমাকে কিছুই করতে হবে না। আমি শুধু সিদ্ধান্ত নেব যে আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না। তখন আমার মস্তিষ্ক শরীরকে শীতল করে নেবে, হৃৎপিণ্ড রক্তসঞ্চালন কমিয়ে দেবে, আমার মেটাবলিজম বন্ধ হয়ে আসবে। আমি বাচতে চাই কি না চাই সেটা আমার ইচ্ছা।
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না, অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি যখন অস্ত্র হাতে আমাকে হত্যা করতে এলে আমি ভেবেছিলাম আমি তোমাকে হত্যা করতে দেব, ঠিক তখন তোমার মস্তিষ্কের মাঝে আমি শুনতে পেলাম একটি কোমল কথা–তখন আর পারলাম না, সরে গেলাম।
আমি তোমার কাছে সে জন্য কৃতজ্–আমাকে একজন হত্যাকারী হতে হল না। শুধু তাই না–তোমার সাথে আমার পরিচয় হল– আমি এক মুহূর্ত থেমে বললাম, তোমার কোনো নাম নেই বলে আমার কথা বলতে খুব অসুবিধে হচ্ছে।
আমি তো বলেছি, একটা নাম দিয়ে দাও।
সত্যি?
সত্যি।
ঠিক আছে, এখন থেকে তোমার নাম লাইনা।
বেশ, আমার নাম লাইনা!
আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, তোমার সাথে পরিচয় হয়ে খুব খুশি হলাম লাইনা।
লাইনা আমার হাত স্পর্শ করে বলল, তুমি সত্যিই খুশি হয়েছ দেখে আমারও খুব। ভালো লাগছে কিরি।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি অতিমানবী! তুমি মস্তিষ্কের ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখতে পার–আমি সত্যি বলছি না মিথ্যা বলছি!
ঠিক তখন আমার মস্তিষ্কের মাঝে কে যেন ফিসফিস করে বলল, আমি কোথায়?
আমি গলার স্বরে চিনতে পারলাম, এটি আমার মস্তিষ্কে বসানো ট্রাকিওশান ইশি। আমি মাথা নেড়ে বললাম, তুমি আমার মস্তিষ্কের ভিতরে।
মস্তিষ্ক কী?
তুমি যদি না জান মস্তিষ্ক কী, তোমাকে সেটা বোঝানো খুব কঠিন।
আমি কে?
তোমার নাম ইশি।
আমি কেন?
আমাকে সাহায্য করার জন্য।
আমি কীভাবে তোমাকে সাহায্য করব?
সময় হলেই আমি তোমাকে বলব। এখন আমরা আছি একটা খনির ভিতর, মাটির অনেক নিচে। তাই বাইরে থেকে কোনো সঙ্কেত আসতে পারছে না। কিন্তু আমরা যখন বাইরে যাব সাথে সাথে প্রতিরক্ষা দপ্তর তোমার সাথে যোগাযোগ করবে। তখন তুমি তাদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেবে না।
ঠিক আছে আমি জবাব দেব না।
চমৎকার। তোমার আলাদাভাবে কোনো অস্তিত্ব নেই। তোমার অস্তিত্ব আমার সাথে। আমার অস্তিত্ব রক্ষা করলেই তোমার অস্তিত্ব বেঁচে থাকবে। তাই তুমি সবসময় আমার নির্দেশ মেনে চলবে।
মেনে চলব।
তা হলে তুমি অপেক্ষা কর, যখন প্রয়োজন হবে, আমি তোমায় ডাকব।
আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
ইশি মস্তিষ্কে নিঃশব্দ হয়ে যাবার পর আমি ঘুরে লাইনার দিকে তাকালাম, বললাম, আমি তোমার মতো অতিমানবী নই, আমি সাধারণ মানুষ, সেজন্যই মনে হয় আমি এই জিনিসটা বুঝতে পারছি না। যে আত্মহত্যা করতে চাইছে তাকে কেন হত্যা করতে হবে?
প্রতিরক্ষা দপ্তর জানে না আমরা এখন আত্মহত্যা করতে প্রস্তুত হয়েছি। তারা জানে যে আমরা আর নিজেদেরকে বহন করতে পারছি না।
তা হলে কেন আমরা প্রতিরক্ষা দপ্তরকে সেটা জানিয়ে দিই না? এই নৃশংসতা কেন বন্ধ কর না?
করে কী হবে?
হয়তো তোমাদেরকে প্রজেক্ট অতিমানবীর ল্যাবরেটরিতে নেওয়া যাবে, হয়তো তোমাদের অতিমানবিক জিনিস পরিবর্তন করে তোমাদের সাধারণ মানুষে পরিবর্তন করা যাবে। হয়তো তোমরা সাধারণ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে পারবে।
তোমরা? তুমি তোমরা কথাটি ব্যবহার করছ কেন?
কারণ তুমি নিজেই বলেছ তোমার একার অস্তিত্ব পূর্ণাঙ্গ নয়। সবাই মিলে তোমার অস্তিত্ব।
লাইনা ঝট করে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সত্যিই আমাদের সবাইকে একত্র করতে পারবে!
আমি জানি না লাইনা। আমি নিচু গলায় বললাম, কিন্তু আমার মনে হয় সবকিছু জানতে পারলে প্রতিরক্ষা দপ্তর নিশ্চয়ই তোমাদের সবাইকে হত্যা না করে ল্যাবরেটরিতে ফিরিয়ে নেবে।
তোমার তাই মনে হয়?
আমার তাই মনে হয়। তুমি যদি রাজি থাক আমি চেষ্টা করতে পারি।
লাইনা কয়েক মুহূর্ত চেষ্টা করে বলল, ঠিক আছে চেষ্টা করে দেখ। আমি আমার সমস্ত অস্তিত্বগুলো একনজর দেখার জন্য সমস্ত বিশ্ব দিয়ে দিতে পারি। মৃত্যুর পূর্বে সবাই মিলে যদি একবারও পূর্ণাঙ্গ একটি অতিমানবী হতে পারি, আমার কোনো ক্ষোভ থাকবে না।
বেশ। আমি চেষ্টা করব। কিন্তু তার আগে আমাকে কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে।
কী ধরনের প্রস্তুতি?
আমি প্রতিরক্ষা দপ্তরকে বিশ্বাস করি না। প্রয়োজনে যেন তাদেরকে ভয় দেখাতে পারি সেই প্রস্তুতি।
০৫. পরিত্যক্ত খনি থেকে
পরিত্যক্ত খনি থেকে বের হওয়ামাত্রই ইশি আমার মস্তিষ্কে ফিসফিস করে বলল, আমাকে কেউ একজন ডাকছে।
প্রতিরক্ষা দপ্তর। উত্তর দেবার কিছু প্রয়োজন নেই।
কেন উত্তর দেবার কোনো প্রয়োজন নেই?
আমি কোথায় সেটা জানতে দিতে চাই না। তুমি উত্তর দেওয়ামাত্র আমার অবস্থান জেনে যাবে।
তোমার অবস্থান জানলে ক্ষতি কী?
আসলে কোনো ক্ষতি নেই। আমার অবস্থান আগে হোক পরে হোক জেনে যাবেই। কিন্তু আমি একটু সময় চাইছি।
আমি পরিত্যক্ত খনি থেকে অনেক কষ্টে শহরে ফিরে এলাম। নিজের বাসায় একদিন শুয়ে–বসে কাটিয়ে দিলাম। পরদিন শহরতলিতে পানশালায় গেলাম নিফ্রাইট মেশানো পানীয় খেতে। সেখানে কোমের সঙ্গে দেখা হল–আমার সাথে যে বেশ কয়েকদিন দেখা হয় নি সেটা নিয়ে কোম কিছু সন্দেহ করল না। আমরা পানীয়তে চুমুক দিয়ে শিল্প–সাহিত্য–সংস্কৃতি এই ধরনের বড় বড় ব্যাপার নিয়ে কথা বললাম। উঠে আসার সময় কোমকে জিজ্ঞেস করলাম, হিম নগরীতে যাবার সহজ রাস্তা কি জান?