কেন?
সবাই মিলে ওরা একটা সত্তা ওদের যেকোনো একজন মারা গেলে ওদের সবারই মৃত্যুর অনুভূতি হত। এমনিতে সাধারণ কোনো মানুষ একবারের বেশি মৃত্যুর অনুভূতি অনুভব করতে পারে না–কিন্তু এই অতিমানবেরা বারবার সেই অনুভূতি অনুভব করত। বিজ্ঞানীরা মানুষের সেই অনুভূতি নিয়ে গবেষণা করতেন।
কিন্তু এটি তো নিষ্ঠুরতা।
নিষ্ঠুরতা কথাটির একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে। যে কাজ পশুর বেলায় করা হলে সেটি নিষ্ঠুরতা নয়, মানুষের বেলায় সেটি নিষ্ঠুরতা। পশুকে কেটেকুটে রান্না করে খাওয়া হয়, মানুষের বেলায় সেটা চিন্তাও করা যায় না। প্রচলিত অর্থে এইসব শিশুকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হত না। তাই তাদেরকে নিয়ে যেসব কাজ করা হত সেগুলো হত বৈজ্ঞানিক গবেষণা, সেগুলোকে কেউ নিষ্ঠুরতা মনে করত না।
আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, তুমি কি এই অতিমানব প্রজেক্টের এক জন?
মেয়েটি কথা না বলে সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি তা হলে বেঁচে আছ কেমন করে?
মেয়েটি বিচিত্র একটি ভঙ্গিতে হেসে বলল, বলতে পার প্রকৃতির এক ধরনের খেয়াল। ঠিক যে জিনটি আমাদের পাঁচ বছর পর হত্যা করত, মিউটেশানে তার পরিবর্তন হয়ে গেছে। ধ্বংসকারী সেই জিনের মাত্র একটা বেস পেয়ারের পরিবর্তন হয়েছে, যেটা হওয়ার কথা ছিল সি–এ–জি সেটা হয়েছে ইউ–এ–জি। যেখানে এমিনো এসিড গ্লুটামাইন তৈরি হওয়ার কথা সেখানে প্রোটিন সিনথেসিস বন্ধ হয়ে গেছে।
পাঁচ বছর পার হওয়ার পর যখন অক্সিজেনের অভাবে আমাদের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবার কথা, আমরা কেউ মারা গেলাম না। আমাদের ডি. এন. এ. পরীক্ষা করে প্রজেক্ট অতিমানবীর বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করল আমরা নিজে থেকে মারা যাব না। আমাদের একজন একজন করে হত্যা করতে হবে। কর্মকর্তারা কীভাবে মারা হবে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে ফেলল, আমরা আরো একটু বড় হয়ে গেলাম।
ট্রাকিওশান লাগিয়ে যখন আমাদেরকে প্রথমবার আত্মহত্যা করানো হল তার আঘাত হল ভয়ানক। দ্বিতীয়বার যখন আমাদের হত্যা করা হল আমাদের পক্ষে সেটি গ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ল। মৃত্যুর পর কেউ ফিরে আসে না তাই পৃথিবীর কেউ মৃত্যুর অনুভূতি জানে না। আমরা জানি। আমাদের একজন যখন মারা যায় তখন আমরা সবাই সেই ভয়ঙ্কর কষ্ট অনুভব করি, ভয়ঙ্কর হতাশা আর এক অকল্পনীয় শূন্যতা অনুভব করি। তোমরা সেই অনুভূতির কথা কল্পনাও করতে পারবে না।
মেয়েটির মুখে একটি গাঢ় বিষাদের ছায়া এসে পড়ল। সে ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা সেই কষ্ট আর সহ্য করতে পারলাম না, একদিন তাই ল্যাবরেটরি থেকে পালিয়ে গেলাম।
পালিয়ে গেলে! আমি অবাক হয়ে বললাম, তোমরা পাঁচ–ছয় বছরের শিশু কেমন করে প্রতিরক্ষা দপ্তরের এত বড় ল্যাবরেটরি থেকে পালিয়ে গেলে?
মেয়েটা একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমরা তখন ঠিক পাঁচ–ছয় বছরের শিশু নই, আরো একটু বড় হয়েছি। তা ছাড়া আমরা ছিলাম অতিমানবী, আমরা বড় হই অনেক দ্রুত। আমাদের ক্ষমতাও অনেক বেশি, আমরা মানুষের মনের মাঝে ঢুকে যেতে পারি। ভাবনা চিন্তা বুঝে ফেলতে পারি। মানুষের মস্তিষ্ককে খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আমরা যদি পালিয়ে যেতে চাই আমাদের আটকে রাখা খুব কঠিন।
পালিয়ে তোমরা কোথায় গেলে?
মেয়েটা বিষণ্ণ গলায় বলল, প্রথমে আমরা সবাই একসাথে ছিলাম। তখন প্রতিরক্ষা দপ্তরের ঘাতকদল এক জন এক জন করে আমাদের হত্যা করতে শুরু করল। নিজেদের রক্ষা করার জন্য আমরা তখন ছড়িয়ে–ছিটিয়ে গেলাম।
মেয়েটা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, যখন আমরা আলাদা আলাদা হয়ে গেলাম তখন প্রথমবার আমাদের সত্যিকারের সমস্যাটির কথা জানতে পারলাম।
সেটি কী?
আমরা ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ। আমাদের অতিমানবিক মস্তিষ্কের সঙ্গী হতে পারে শুধুমাত্র আমাদের মতো আরেকজন। তাদেরকে ছেড়ে আমরা যখন আলাদা হয়ে গেলাম মনে হতে লাগল আমাদের বুঝি একটি নিঃসঙ্গ এহে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের এই জীবনের কোনো মূল্য নেই।
তা হলে তোমরা কী করবে?
এই অতিমানবী প্রজেক্ট একটি অত্যন্ত অমানবিক অত্যন্ত হৃদয়হীন প্রজেক্ট। এই প্রজেক্টে আমাদের মতো কিছু অতিমানবী তৈরি হয় কিন্তু তারা আবিষ্কার করে এই পৃথিবী তাদের জন্য নয়। তুমি জান আমাদের কিছু অনুভূতি আছে যেগুলো কী ধরনের তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না।
সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
কী রকম সেই অনুভূতি?
আমি কেমন করে তোমাকে বোঝাব! যেমন মনে কর শব্দ। তুমি তো শব্দ শোন, তুমি কি জান প্রতিটি শব্দের একটা আকার আছে, একটা রং আছে?
শব্দের রং? আকার?
হ্যাঁ, তুমি সেটা চিন্তাও করতে পার না। কিন্তু আমরা সেটা দেখি। তোমাদের দুঃখের অনুভূতি আছে এবং সুখের অনুভূতি আছে কিন্তু তুমি কি জান যে তীব্র এক ধরনের সুখের অনুভূতি আছে, সেটি এত তীব্র যে সেটা যন্ত্রণার মতো?
আমি মাথা নাড়লাম, না, জানি না।
তোমাদের জানার কথাও নয়। তোমরা সৌভাগ্যবান, যেসব অনুভূতি তোমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তোমাদের শুধু সেই অনুভূতি দেওয়া হয়েছে। আমাদের বেলায় সেটা সত্যি নয়, আমাদের করার কিছু নেই কিন্তু সেই অনুভূতি আমাদের বহন করে যেতে। হয়।